খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার মেয়ে জান্নাত আরা আক্তার ওরফে শিমুল। ২০০৭ সালে মানিকগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দেন নার্স হিসেবে। এরপর আরও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র ২/৩ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করেন আরও প্রায় এক দশক। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যোগ দেন মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে। এরপর হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। অভিযোগের পাহাড় গড়ে ওঠতে শুরু করে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তুলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে। এক পর্যায়ে সেই সম্পর্ক গড়ায় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পর্যন্ত। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি নার্স জান্নাত আরা শিমুলকে। সীমাহীন অভিযোগ থাকলেও কেউ কোন শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি নার্স শিমুল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সরকারি যন্ত্রপাতি চুরি করেও রেহাই পেয়েছেন এই দাপুটে এই নার্স।
তবে বিধি বাম হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। কৌশলে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান জান্নাত আরা শিমুল। বেশ কয়েকবার নোটিশ করা হলেও যোগ দেননি তার কর্মস্থল মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে। বিএনপিপন্থী নার্স ও ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়েও মিলেছে না প্রতিকার। টাকার বান্ডিল প্রপোজ করেও যোগ দিতে পারছেন না জেলা হাসপাতালে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার মিরেরডাঙ্গা গ্রামের আফজাল শেখের মেয়ে জান্নাত আরা আক্তার। পুরো নাম জান্নাত আরা আক্তার হলেও হাসপাতাল এলাকায় তিনি শিমুল নামে বহুল পরিচিত। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুড়ি ইউনিয়নের কাকজোর গ্রামের আলতাফ হোসেনের বড় ছেলে আতিকুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। নার্স হিসেবে কর্মরত থাকলেও শ্বশুরবাড়ি এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন জান্নাত আরা।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সরকারিভাবে যান হজেও। মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালের দাপুটে এই নার্স দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন অপারেশন থিয়েটারের ইনচার্জ হিসেবে। যেখানে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে প্রতি মাসে লুটে নেন লক্ষ লক্ষ টাকা। কোন নার্স বা সংশ্লিষ্ট কেউ এর প্রতিবাদ করলেই তাকে হাসপাতাল থেকে বদলীর কবলে পড়তে হতো। সরকারি নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করে হাসপাতালে গড়ে তুলেন সিন্ডিকেট।
জেলা হাসপাতালের ওটি রুমের ১০টি বায়োপোলার ডায়াথেরামি মেশিন চুরির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এতো কিছুর পরেও বহাল তবিয়তে ছিলেন জান্নাত আরা। তবে সরকার পতনের পর ভাগ্যবদলের দাঁড়িপাল্লায় রয়েছেন তিনি। এখনো যোগদান করতে পারেনি তার কর্মস্থল মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নার্স বলেন, শিমুলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার মতো হাসপাতালে কেউই ছিল না। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আফসার চেয়ারম্যানের বিশ্বস্ত থাকায় যা খুশি তাই করতো শিমুল। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে বদলী বা হয়রানির শিকার হতে হতো। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হয়েছিলেন নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সেক্রেটারি। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর পর থেকে তাকে আর হাসপাতালে দেখা যায়নি বলে জানান তারা।
মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনুর রহমান বলেন, হাসপাতালে সরকারি ওষুধ সরবরাহ থাকার পরও সার্জারি বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনদেরকে দিয়ে হাজার হাজার টাকার ওষুধ কেনাতে বাধ্য করতো জান্নাত। সকালের আনা সেই ওষুধ আবার বিকেলেই ফেরত দেওয়া হতো সংশ্লিষ্ট ফার্মেসিতে। এর প্রতিবাদ করায় তাকে চার বার হাসপাতাল থেকে বদলী হতে হয়েছে। শুধু তাই নয় শারীরিকভাবে নাজেহাল করা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়েছে বলে দাবি করেন শাহিন। এসব কিছু হয়েছে জান্নাত ও তার সিন্ডিকেটের ইশারায়।
এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার হাসপাতালে গিয়েও দেখা পাওয়া যায়নি জান্নাত আরা আক্তারের। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জান্নাত আরা বলেন, আমার সম্পর্কে আনিত অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। যন্ত্রপাতির বিষয়টিও মীমাংসা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, হাসপাতালের দায়িত্বরত সিনিয়র নার্সদের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে জান্নাত আর শিমুলকে অপারেশন থিয়েটারের ইনচার্জের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার পতনের পর থেকে হাসপাতালে অনুপস্থিত জান্নাত আরা। বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করার পরও জান্নাত হাসপাতালে যোগ দেননি বলে জানান তিনি।