বাংলাদেশে নদী রক্ষায় অনেক আইন আছে, নদী রক্ষার মূল দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের । এছাড়া আছে বিআইডব্লিউটিএ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, নদী রক্ষা কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু সঠিকভাবে কেউ দায়িত্ব পালন করে না।
মাঝে-মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ২-১ দিনের অভিযান চালানো হয়। তারপর সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। যুগ যুগ ধরে চলছে এ অবহেলা ও নদীর ওপর অত্যাচার। কর্মকর্তারা থাকেন নিজেদের পদ-পদবী ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। আর সুশীল সমাজ ব্যস্ত সভা-সেমিনার ও দিবস উদযাপনে।
এদেশের তরুণ প্রজন্মের অফিসার হিসেবে নদী রক্ষায় প্রথম অভিযানে নেমেছিলেন মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। ১৯৯৭ সালে চাঁদপুরে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ১১০ একর অবৈধ দখলমুক্ত করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। তার ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। এরপর ২০০০ সাল থেকে মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দরে কর্ণফুলী নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার অভিযানে নামেন। ভেঙে দেন বড় বড় শিল্প কারখানা, অবৈধ জেটি ও স্থাপনা ।
কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরে শত শত কিলোমিটার চষে বেড়িয়েছেন মুনীর চৌধুরী। তার দুর্ধর্ষ অভিযানে বহু দেশি ও বিদেশি জাহাজ আটক ও দন্ডিত হয়। বিদেশি জাহাজগুলোর মাধ্যমে নদী ও সমুদ্রে দূষণ ছড়িয়ে যেত। সেগুলো হাতে-নাতে আটক করা হতো। কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরকে মুনীর চৌধুরী রাডারের মতো পাহারা দিয়ে রাখতেন। সেসময় এসব অভিযানে তার সাথে কোন পুলিশ বাহিনী ছিল না। রাতে ও দিনে ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে নদী দূষণ ও দখল বিরোধী অভিযান চালিয়ে তিনি অসংখ্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এমনকি চট্টগ্রামের হালদা নদীতেও ২০০৪ সালে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে নদী তীরে কারখানার বর্জ্য দূষণ বন্ধ করেন। এমনকি কর্ণফুলী নদীমুখী বহু কারখানার বর্জ্যের পাইপ লাইন করে দেন। বিশেষত: হাক্কানী পেপার মিল্স, রিজেন্ট টেক্সটাইল মিল্স, ডায়মন্ড সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, টিএইচপি কারখানা চট্টগ্রাম সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সহ বহু ফ্যাক্টরির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী নদীকে রক্ষা করেন। এমনকি কর্ণফুলী নদী দখলকারী বহু অবৈধ ডকইয়ার্ডও মুনীর চৌধুরী ২০০২ ও ২০০৩ সালে উচ্ছেদ করেন।
সেসময় রাজনৈতিক সরকারের বহু মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তাকে থামাতে পারেনি। এমনকি চট্টগ্রামের ক্ষমতাসীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর পতেঙ্গার অবৈধ জেটি উচ্ছেদ করেন। এছাড়া বড় বড় রাজনৈতিক শক্তিধরদের অবৈধ ড্রেজিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ রক্ষা করেন। অনেকের স্মৃতি থেকে হয়তো বা হারিয়ে গেছে এসব অভিযানের ঘটনা। এরপর ২০০৩ সালে মুনীর চৌধুরী সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে সারা দেশের নদ-নদীতে চালান সাঁড়াশি অভিযান। সে অভিযানে তদানীন্তন সরকারের বহু মন্ত্রী, এমপি এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী পরিবারের জাহাজ আটক করা হলে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। পুনরায় ২০০৪-২০০৭ সাল পর্যন্ত কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরে সাহসী অভিযান চালিয়ে নদী রক্ষায় মুনীর চৌধুরী অনন্য অবদান রাখেন। কিন্তু ১/১১ সরকারের সময় প্রভাবশালীদের চাপে তাকে বগুড়ায় বদলি করে দেয়া হয়।
২০১০ সালে তাকে পরিবেশ অধিদপ্তরে নিয়োগ দেয়া হলে তিনি পাহাড়, বনভূমি ও কৃষিজমি রক্ষার পাশাপাশি সারাদেশের নদ-নদী রক্ষায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে এই প্রথম পরিবেশ আইনে নদী দূষণের জন্য মুনীর চৌধুরী জরিমানা আরোপ শুরু করেন। তার উদ্যোগে ও নেতৃত্বে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, মেঘনা, ক্ষীরো, সুরমা, বংশী নদ-নদীতে চলে ক্লান্তিহীন অভিযান। বিশেষ করে শিল্প কারখানার বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র না থাকার অথবা চালু না থাকার অজস্র ঘটনা উদঘাটন করেন তিনি।
২ বছরের ক্লান্তিহীন অভিযানে মুনীর চৌধুরী বড় বড় শিল্প কারখানা গুলোর ৭০ শতাংশ বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র স্থাপনে বাধ্য করেন, যা নদী দূষণ বন্ধে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। দিনে-রাতে কারখানাগুলোতে চালানো হতো আকস্মিক অভিযান। হাতে-নাতে ধরা হতো নদী দূষণ। কয়েক ঘণ্টার নোটিশে ভেঙে ফেলা হতো নদীর অবৈধ স্থাপনা। এই অভিযানে বেশির ভাগ দন্ডিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের বহু মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান। এমনকি বসুন্ধরা কাগজ কারখানাকে মুন্সিগঞ্জে ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। যুগান্তরের মালিক নুরুল ইসলামের যমুনা ডেনিম কারখানায় অভিযান চালিয়ে ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ হাসান রিপনের কারখানা কে জরিমানা করা হয় ৫০ লাখ টাকা, ইবনে সিনাকে জরিমানা করা হয় ৫০ লাখ টাকা, মেঘনা নদী দখলের দায়ে মেঘনা গ্রুপের ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়, মেঘনা নদীতে ইউনিক গ্রুপের অবৈধ আবাসন উচ্ছেদ করে ৫০ লাখ টাকা, মেঘনা গ্রুপের দখল থেকে মুক্ত করা হয় ৩০০০ একর নদী তীরবর্তী ভূমি।
এসব অভিযান ছিল অবাক করার মতো কাহিনী। জীবন বাজি রেখে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে মুনীর চৌধুরী চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলা ও মন্ত্রীদের। এভাবে ভীত কেঁপে ওঠে নদী দখলদার ও দূষণকারীদের। শেষ পর্যন্ত পরিবেশ মন্ত্রী হাসান মাহমুদের সাথে শুরু হয় মুনীর চৌধুরীর তীব্র দ্বন্দ্ব। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়। মুনীর চৌধুরী মন্ত্রী হাসান মাহমুদের নির্দেশে অভিযান বন্ধ না করে বরং অভিযানের তীব্রতা ও মাত্রা বাড়িয়ে দেন। মুনীর চৌধুরী সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রজন্ম কে নিয়ে গঠন করেন গ্রিন ব্রিগেড নামক সংগঠন, তরুণদের তিনি সরেজমিনে তিনি নদীতে নিয়ে যান, কীভাবে নদী দূষণ ঘটে তা দেখানো হয়। একদিকে চলেছে মুনীর চৌধুরীর অভিযান, অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকতারা ব্যস্ত থাকতো বিদেশ ভ্রমণে। কোনভাবে মুনীর চৌধুরীকে বিদেশ পাঠানো যেত না মর্মে মহাপরিচালক অভিযোগ করতেন।
আজ ২২ সেপ্টেম্বর 'বিশ্ব নদী দিবস' পালিত হচ্ছে, অনেক সভা- সেমিনার হবে, অনেক ব্যানার টাঙানো হবে, অনেক বড় বড় কথা বলা হবে। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর মতো নদী রক্ষায় দেশপ্রেমিক ও কর্মবীর মানুষ পাওয়া যাবে না। দূষণকারী ও দখলদারদের সিন্ডিকেট পরিবেশ মন্ত্রী হাসান মাহমুদকে প্রভাবিত ও প্ররোচিত করে ২০১২ সালে মুনীর চৌধুরী কে বদলি করে দেন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে। এরপর পরবর্তী কর্মস্থলে দায়িত্বপালন শেষে ২০১৭ সালে দুদকে মহাপরিচালক পদে যোগ দেন মুনীর চৌধুরী । এখানে এসেও তিনি নদ-নদীকে ভুলে যাননি। দুদকে এসে নদী রক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন নতুন উদ্যমে, বিপ্লবী চেতনায়। আবারও গঠন করেন স্পেশাল ব্রিগেড। তাতে ছিল দুদক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ। বিশেষ করে অবৈধ বালু উত্তোলন ও নদী তীর কাটার দায়ে বহু ড্রেজার আটক করা হয়, গ্রেফতার করা হয় নদী দখলদারদের। একদিনে এক শক্তিশালী টিম নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও মেঘনা নদী পয়েন্ট থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ধাওয়া করেন অবৈধ ড্রেজিং ও নদী দখলদারদের । আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নদী দখলদাররা।
নদী রক্ষার এ অভিযানে দুদককে সম্পৃক্ত দেখে কেঁপে ওঠে প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও অন্যরা আরও সক্রিয় হয় । দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে তীব্রতা বাড়লে ২০১৯ সালে দুদক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই যবনিকাপাত ঘটে নদী রক্ষার অভিযানে।
নদী রক্ষার শপথ নেওয়া দরকার, নদী দিবসে কথার ফুলঝুড়ি না ছড়িয়ে কাজ বেশি প্রয়োজন। মরহুম নৌ পরিবহন মন্ত্রী কর্নেল অব আকবর হোসেনের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, 'মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশে একজনই। তাকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে দেশবাসী খুঁজে নেবে।'