এমপি শামীমে জিম্মি আরইবি

, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-09-23 08:58:31

সরকার দলীয় সংসদ সদস্যকে কাজ দিতে হেন কাজ নেই করেনি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। উপকেন্দ্র নির্মাণে ৭৭৩ কোটি টাকার দরপত্র ১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ ও স্মার্ট মিটার প্রকল্পে বেশি দর দিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উপকেন্দ্র আধুনিকায়নের এক প্রকল্পেই ২২৭ কোটি টাকা বাড়তি বিল গুনতে হবে আরইবিকে। আগের কাজ শেষ না হতেই আরও একটি লটে ওই কোম্পানিকে অস্বাভাবিক দরে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে এনেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন যেহেতু ভিন্ন পরিস্থিতি সে কারণে নতুন লটের যাচাই-বাছাইয়ের দাবি উঠেছে। প্রতিযোগিতামূলক দর নিশ্চিত করা গেলে কমপক্ষে ১শ কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন খোদ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) লোকজন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আরইবির খুলনা জোনের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ক্ষমতাবর্ধন প্রকল্পে ওই হরিলুটের ঘটনা ঘটেছে। যে কাজগুলো পেয়েছেন টিএস ট্রান্সফরমার। যার মালিকানায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দীন (শামীম)। যিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনে কুমিল্লা-৮ (বরুরা) আসন থেকে নির্বাচিত হন। কথিত রয়েছে দরপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে দেড় দশকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন তিনি। সেই টাকার জোরে ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেট নিশ্চিত করেন। আর বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে সংসদে সদস্যের লেবেল লাগাতে সক্ষম হন।

বিদায়ী সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কোন কর্মকর্তা কথা শুনতে না চাইলে খোদ প্রতিমন্ত্রী নাম করে হুমকি দেওয়া হতো। ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা হতো। শুধু বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর সখ্যতা নয়, শেখ রেহানার ছেলে ববি ও তার বন্ধুর সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল বলে জাহির করতেন। ববির জন্মদিনে উইশ করতে হাস্যজ্জল ছবিযুক্ত ফটোকার্ড পোস্ট করেন। তাতে ইংরেজিতে লেখেন 'হ্যাপি বার্থ ডে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। নিচে ছোট করে লেখা আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দীন এমপি কুমিল্লা-৮, বরুরা।'

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো ১৬ বছর ধরে আরইবিতে ছিল একক আধিপত্য। নানা কৌশলে কয়েক বছর ধরে টেন্ডারবাজি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছেন আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দীন। দ্বিগুণ দর আদায়সহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তার কোম্পানির বিরুদ্ধে। আরইবির একটি চক্র ছিল যারা টিএস ট্রান্সফরমারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।

২০২২ সালে ৮টি প্যাকেজ আওতায় ৩৭টি জিআইএস সাবস্টেশন নির্মাণের দরপত্র চাওয়া হয়। দ্বৈত খাম পদ্ধতির ওই দরপত্রে ৯টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও নানা ছুঁতোয় ৬ প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করে দেওয়া হয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কারণ জানতে চাইলে নানা রকম ভয়-ভীতি দেখানো হয়। বিশ্বখ্যাত অনেক কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দরপত্র বাতিল করা হয়। কাজ পাবে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান, সেটি নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন তাই করেছেন প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)।

প্যাকেজ কেডি ডব্লিউ-১ এর আওতায় ছিল ৫টি (২*১০/১৪ এমভিএ) উপকেন্দ্র। প্যাকজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৪ ইউএস ডলার। কিন্তু টিএস ট্রান্সফরমার জেভি এনার্জি প্যাককে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৯ ইউএস ডলারে কার‌্যাদেশ দেওয়া হয়। যা প্রক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। টিএস ট্রান্সফরমার জেভি এনার্জি প্যাককে মোট ৫টি প্যাকেজে ৩৫টি সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়, যার প্রত্যেকটিতে ৩০ শতাংশ দর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবে ৭৭৩ কোটি টাকার দরপত্র ১ হাজার কোটি টাকা বিল প্রদান করে আরইবি।

একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উপকেন্দ্র নির্মাণ দরপত্রে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে এতো বেশি বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা নজির বিহীন। টিএস ট্রান্সফরমার শুধু উপকেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েই ক্ষান্ত হন নি। স্মার্ট মিটার, ট্রান্সফরমার ও খুঁটি সরবরাহ থেকেও কয়েকশ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। শফিউদ্দীনের অপর প্রতিষ্ঠান এসকিউ ওয়্যার এন্ড ক্যাবলস এর মাধ্যমে ৬ হাজার টাকা দরে যে মিটার দিয়েছেন, একই মিটারের বিপরীতে আগের লটের বিল নিয়েছেন ১২ হাজার টাকার উপরে। আরএফ মডিউলসহ সিঙ্গেল ফেজ মিটার ১২ হাজার ২৫৩ টাকা দরে বিল তুলেছেন ২০২২ সালে। ওই টেন্ডারের ১০ মাস পর ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এ (প্যাকেজ ২৩-২৪ ঢাকা পিবিএস-১.০এন্ড এম-১) খোলা দরপত্রে একই মিটার মাত্র ৬৩৮২ টাকায় দর জমা দেন। এমন সব অসঙ্গতি থাকলেও আরইবি তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং অন্যান্যরা চোখ বন্ধ করে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে তৎকালীন আরইবি চেয়ারম্যানকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে সচিব করা হয়। 

৪ লাখ ৯০ হাজার সিঙ্গেল ফেজ মিটার ক্রয় ও স্থাপনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ প্রতিযোগিতামূলক কাজ দেওয়া গেলে অর্ধেক দামে মিটার স্থাপন করার সুযোগ ছিল। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেই তার নজির বিদ্যমান। তার এসব দুর্নীতি অনিয়মের আরইবির কিছু কর্মকর্তাও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। যারা আরইবির স্বার্থ না দেখে টিএস ট্রান্সফরমারের পক্ষে কাজ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টিএস ট্রান্সফরমারকে কাজ দিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন ওই প্রকল্পের পরিচালক মাহবুবুর রহমান, আরইবির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী।

প্রকল্পের পরিচালক মাহবুবুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'যা করা হয়েছে নিয়ম মেনেই করা হয়েছে, এখানে অন্যায় কিংবা কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। দর বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী করা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্প কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাদেরকে অবগত করতে হয়েছে। এখানে দুর্নীতির সুযোগ নেই।' 

৩০ শতাংশ দর বেশি দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, 'কারণ ছাড়া দর বাড়ানো হয় নি। আগে আমাদের জিআইএস সাবস্টেশন ছিলনা এ কারণে দরপত্রে কিছু ত্রুটি ছিল।' চিহ্নিত ঠিকাদারকে কাজ দিতে অন্যদের টেকনিক্যালি বাতিল করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, 'এমন করার সুযোগ নেই।' 

কি কারণে তাদের বাতিল করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোন তথ্য দিতে অপারগতা জানান তিনি।

আরইবির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তীকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি। এমনকি অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায় নি।

টিএস ট্রান্সফরমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দীনের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে এসকিউ ওয়্যার এন্ড ক্যাবলস কোম্পানির পরিচালক মাহবুবুর রহমান নিজে থেকেই বার্তা২৪.কমকে ফোন দেন। তিনি বলেন, 'আমরা ওপেন টেন্ডারে কাজ পেয়েছি, কোন রকম অনিয়ম করা হয় নি। রাষ্ট্রের যথাযথ আইন মেনেই কাজ পেয়েছি। আমাদের কোম্পানির মাধ্যমে ১০ হাজার পরিবারের সংসার চলছে। পারলে যারা বিনা টেন্ডারের কাজ পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লেখেন। যারা বিদেশি কোম্পানি এনে কাজ নিয়েছেন, সব টাকা বিদেশে চলে গেছে। তাদের কথা লেখেন দেশ উপকৃত হবে।' 

এ সম্পর্কিত আরও খবর