শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের শপথ বাক্য পাঠ করানো বাড়াবাড়ি: নুর

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-09-28 15:42:15

শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের শপথ বাক্য পাঠ করানো ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গার্ড অব অনার নেওয়া অতি বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।

শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির অয়োজনে 'শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও ছাত্র রাজনীতি' নিয়ে অনুষ্ঠিত ছায়া সংসদ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, আমরা দেখলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমন্বয়করা শপথ পড়াচ্ছেন। ছাত্ররা কি শিক্ষকদের বস হয়ে গিয়েছেন যে তাদেরকে শপথ পড়াচ্ছেন? হ্যাঁ যদি সেই পর্যায়ে যেতে পারেন তারপরেও এটা করতে পারেন না। এটা যারা করেছেন তাদের মধ্যে মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটা দুর্ভাগ্য যে যারা লঙ্কায় যায় তারাই রাবণ হয়। সুযোগ পেলে সবাই নিজেকে জাহির করতে চায়। এমন একটা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারাই এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এমন কাজ করছে এটা কোনোভাবে আমি সমর্থন করতে পারছি না। আগামী বাংলাদেশকে আমরা যদি এগিয়ে নিতে চাই রক্তের বদলে রক্ত, লাশের বদলে লাশ, এই প্রবণতা যদি চলতে থাকে তাহলে আপনি পরিবর্তন ঘটাবেন কিভাবে।

ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি এতদিনে যে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলেছে ছাত্রলীগ তার একটা পার্ট ছিল। শুধু ছাত্রলীগ না। এই সরকার যে ফ্যাসিস্ট হয়েছে শুধু কি ছাত্রলীগ তৈরি করেছে? প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যম কর্মীদের একটি অংশ তাকে ফ্যাসিস্ট বানিয়েছে। বিভিন্ন বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ বিগত সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পরিণত করেছে। এই প্রত্যেকটা ফ্যাসিস্ট শক্তির বিচার হওয়া দরকার।

তিনি আরও বলেন, কোনো সাংবাদিক বা কোনো অ্যাক্টিভিস্ট তারা মেইন রোলটা প্লে করেনি। তারা হয়তো কেউ একটা পক্ষে কলাম লিখেছে বা কেউ একটা কথা বলেছে। তারা কিন্তু প্রধান কালপ্রিট না। এখনও প্রধান কালপ্রিটরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমার সন্দেহ সরকার কি তাদেরকে একটা স্পেস দিছে কিনা। কিছুদিন আগে ৫৬ জন ডিসি নিয়োগ হয়েছে। সেখানে অভিযোগ এসেছে আমাদের এই আন্দোলনের সময় নায়কদের কেউ কেউ ডিসি এসপি অ্যাপয়েন্টেড করেছেন। ৫৬ জনের মধ্যে ৪৯ জন ডিসি আগের সরকারের নিয়মিত সুবিধাভোগী। তাহলে এই যে আমরা একটা পরিবর্তন এর রাজনীতির কথা বলছি যারা আমাদের এই পথ দেখানো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাদের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে যদি ডিসি অ্যাপয়েন্টেডের অভিযোগ আসে সেটা কিন্তু এই আন্দোলনকে ফেলে দেয়। সুতরাং এই কাজের সাথে কে ইনভল্ভ ছিল সেটার একটা তদন্ত এবং বিচার হওয়া দরকার।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব আছে, যাদের মধ্যে দেশপ্রেম আছে তারা যদি অন্য মতাদর্শের হয় আমি মনে করি অবশ্যই তাদের সম্পদে থাকার যোগ্যতা আছে। সেখানে অন্যায় ভাবে কাউকে পদত্যাগ করানো, হেনস্তা করা লাঞ্চিত করা, এটা করা যাবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি কিছু কিছু জায়গা হয়েছে। লোকাল প্রাইমারি স্কুল হাই স্কুল কিংবা কলেজ এগুলো কিন্তু লোকাল রাজনীতির বলি হয়ে প্রিন্সিপাল কিংবা ফেক আন্দোলন গড়ে তুলে তাদেরকে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। অনেকের আবার জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। এটা কিন্তু ছাত্র রাজনীতি না। মূল দলের লোকেরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলছে অমুকের বিরুদ্ধে তোমরা আন্দোলন করো। তাদের সুবিধার জন্য এগুলো করা হচ্ছে। কেন শিক্ষকরা অনলাইনের চাপের মুখে পদত্যাগ করবে? তাদের ব্যক্তিত্ব আছে না। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে ছাত্রদের পাশাপাশি সবার এর বিরুদ্ধে একটা অবস্থান থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।

সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা চলছিল। তাই ছাত্র জনতার গণ বিপ্লবে আওয়ামী সরকারের পতনের পর শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি না তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত তৈরি হয়েছে। বিগত আওয়ামী সরকারের ছাত্র সংগঠন গত ১৫ বছরে শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র রাজনীতির নামে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। ছাত্রলীগের বিগত সময়ে নানা কর্মকাণ্ড আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।

ছাত্র রাজনীতি হবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে। ছাত্ররা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি করবে না। ছাত্র রাজনীতি শুধুমাত্র কয়েকটি স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের নেতৃত্ব দেওয়া। একজন ছাত্র নেতা যাতে সম্মানের পাত্র হয়, আমাদের গর্ব হয়। আমরা সেই ছাত্রনেতা আমরা চাই, যার নেতৃত্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সমস্যা নিয়ে ছাত্ররা সমবেত হবে। ভয়েস রেইস করবে, গণতন্ত্র সুরক্ষা করবে। শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপূর্ণতা অর্জন করে ভালো মানুষ হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করবে। ভালো আমলা হবে, রাজনীতিবিদ হবে, ব্যবসায়ী হবে, সমাজসেবক হবে। যার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি পরিপূর্ণতা প্রকাশ পাবে। আমরা সেই ছাত্র রাজনীতি চাই যেখানে সিট দখল, হল দখল, র‍্যাগিং, ধর্ষণ, অস্ত্রবাজী, খুন খারাবি থাকবে না।

তাই কখনো ভাবিনি ছাত্র রাজনীতি না থাকলেই হয়তো ভালো হয়। আবার ভাবি এই ছাত্ররাই তো ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১, ৯০সহ সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে আমাদের অধিকার আদায় করেছে। জুলাই বিপ্লবে হাজারেরও বেশি ছাত্র জনতা শহীদ হয়ে দেশে নতুন স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছে। চোখ হারিয়ে, পঙ্গুত্ব বরণ করে হাজার হাজার ছাত্র জনতা এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সর্বশেষ যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে তার অগ্রভাগে ছিল আমাদের ছাত্ররা। হাসিনা সরকারের পতনের এক দফার এই আন্দোলনের নাম ছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলেন। তাহলে কেন আমরা কেন ছাত্র রাজনীতির পক্ষে থাকবো না।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে নিম্নের ১০ দফা সুপারিশ করেন-

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার না বানানো। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন বা দলীয় পরিচয়ের পরিবর্তে ব্যক্তি। বিগত শাসন আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হত্যাকান্ড, যৌন হয়রানী, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিচার দ্রুততম সময়ে করার লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অনিয়মে যুক্ত প্রশাসনের প্রশ্রয় দাতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী বর্তমান প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাদা-লাল-নীল-বেগুনী ইত্যাদি নামকরণের মাধ্যমে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং, টর্চার সেল, হল দখল, সিট দখল, আদিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস দমনে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হওয়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সকল মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের হলে সহাবস্থান নিশ্চিত করা শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। আসন্ন বাজেটে উচ্চা শিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য গবেষণা,বৃত্তি ও কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো।

অনুষ্ঠানে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি'র আয়োজনে "ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের অন্তরায়" শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, জোসিন্তা জিনিয়া, সাংবাদিক সৈয়দ আব্দুল মুহিত, সাংবাদিক শারমিন নাহার নীরা ও জাফর ইকবাল। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর