রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে বন্যার্তদের দুর্ভোগ কাটতে না কাটতেই আবারও পদ্মায় ভাঙন শুরু হয়েছে। নদীর তীরবর্তী মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। যদিও পানি এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি, তবুও উপজেলার চৌমাদিয়া ও আতারপাড়া এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। ভাঙনের ফলে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ভারী বৃষ্টি ও বন্যার কারণে চকরাজাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম, হাটবাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্তত এক হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন সড়কে জমে থাকা হাঁটুপানির কারণে চলাচলে চরম ভোগান্তি দেখা দেয়। এর সঙ্গে শুরু হয় নদীভাঙন, যা মানুষকে আরও বিপাকে ফেলেছে। নিম্ন অঞ্চলের পানি কমতে শুরু করলেও মানুষের দুর্ভোগ এখনো শেষ হয়নি।
শনিবার (০৫ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চকরাজাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হওয়া রাস্তাঘাট থেকে পানি সরে গেলেও কাদা ও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালীদাশখালি গ্রামের তরুণরা, যেমন মনিরুজ্জামান রনি, সাদ্দাম হোসেন, নাসিম, সুমনসহ কয়েকজন, প্লাস্টিকের বস্তায় মাটি ভরে সেসব রাস্তায় ফেলছেন। অন্যদিকে, কৃষকরা গবাদিপশুর খাদ্যসংকটে রয়েছেন, এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
চৌমাদিয়া ও আতারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছে। এই ভাঙনের কারণে আতারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরিয়ে নিতে হয়েছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, ভাঙনের ঝুঁকির কারণে বিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ রয়েছে এবং বিদ্যালয়ের একাংশ ভেঙে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। একইভাবে, চৌমাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সোহেল রানা জানান, বন্যা ও ভাঙনের কারণে কিছু মানুষ বিদ্যালয়ের কক্ষগুলোতে অস্থাবর মালামাল রেখেছে।এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি জমে থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিও অনেক কমে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, কালীদাশখালি, মানিকের চর, পলাশিফতেপুর, নিচ পলাশি, উদপুর, লক্ষ্মীনগর, দিয়াড়কাদিরপুর, চৌমাদিয়া ও আতারপাড়া গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এই গ্রামগুলোর আগাম চাষের সবজিখেত পদ্মার পানিতে তলিয়ে গেছে, স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় বাজার এবং কয়েকটি বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি জমে যাওয়ার ফলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা চরম দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল রহমান জানান, আতারপাড়া ও চৌমাদিয়া গ্রাম দুটি পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় ভাঙনের শিকার হয়ে অর্ধশতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এই পরিবারগুলো বর্তমানে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ বিঘা, যেখানে কালাই ও কলার ফসল নষ্ট হয়েছে।
একই এলাকার সহিদুল ইসলাম বলেন, টানা বৃষ্টি ও পদ্মা নদীর পানির উচ্চতার কারণে বেশ কিছু রাস্তায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তার এলাকায় প্রায় ২০০ বিঘা জমির বেগুন ও সবজিখেত পানিতে ডুবে গেছে, যার কারণে কৃষকরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
দিয়াড়কাদিরপুর গ্রামের সাবিরুল ইসলাম জানান, 'এখন আমাদের এলাকায় কোনো কাজ নেই। সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।'
চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অজিজুল আযম জানান, ইউনিয়নটি পদ্মার চরের মধ্যে হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাড়ে তিন হাজার পরিবারের মধ্যে প্রায় এক হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দী। এছাড়া প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ১০০ পরিবার সরকারিভাবে ১০ কেজি করে চাল সহায়তা পেয়েছে এবং বেসরকারিভাবে ২৫০ পরিবারকে কিছু সহায়তা প্রদান করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে পুনরায় বন্যার শঙ্কা দেখা দিতে পারে।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, উপজেলায় প্রায় ৪৮৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ হেক্টর চরে। তবে আকস্মিক বন্যা ও নিন্মচাপের কারণে নিচু এলাকায় আগাম সবজি, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও পেঁপেবাগান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে ১০০ পরিবারকে চাল দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারিভাবে বরাদ্দ এলে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকেও সহায়তা দেওয়া হবে।