ইউনূস সরকারের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় দলগুলো

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-07 12:58:39

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি তুলেছে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে অনেক দল আবার নির্বাচনী রোডম্যাপের আগে সংস্কারের দাবি তোলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনী কাজগুলো এগিয়ে যাবে।

গত শনিবার (৫ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে দেশের বেশ কয়েকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়। শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর এর আগেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে সরকার। যার ধারাবাহিকতায় ছয়টি সংস্কার কমিশনও গঠন করে।

নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার চায় বিএনপি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এটাই বুঝতে পেরেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মির্জা ফখরুল বলেন, মাস-দিনকাল নিয়ে আমরা কথা বলিনি। ওনারা বলছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তারা সবকিছু দেখছেন। আমাদের দাবিগুলো জনগণের, যেগুলো তাদেরও দাবি। আমরা নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি।

নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ দিতে বলেছি। আমরা এনআইডি কার্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেওয়ার জন্য যে আইন করা হয়েছে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা বাতিল করতে বলেছি। বিতর্কিত কোনও ব্যক্তি যেন কখনো নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে স্থান না পায়, সে কথাও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন তিনি।

নির্বাচনের আগে সংস্কার চায় জামায়াত

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কারের রোডম্যাপের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানের মতে, একটি রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। তাই নির্বাচনের আগে সংস্কার চায় দলটি।

অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তারা এসেছেন। তাদের কাজ হচ্ছে জাতির সামনে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। এজন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তারা সংস্কার করবেন আমরা সেই বিষয়ে কথা বলেছি।

বিগত ১৫ বছর মিথ্যা সংবাদ প্রচার করতে অনেকক্ষেত্রে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে জামায়াতের আমির বলেন, যার ফলে সবচাইতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে জামায়াত। আমরা অতীত নিয়ে ঘাটতে চাই না। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সবার সহযোগিতায় সামনের দিকে এগুতে চাই।

সরকারকে কার্যকরী দেখতে চায় গণতন্ত্র মঞ্চ

অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রো-অ্যাক্টিভ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। প্রশাসন যাতে জবাবদিহিমূলক হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এসময় গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সহযোগী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাউয়ুমসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসক, থানার ওসি, ইউএনও যারা দায়িত্বে তারা যেন সরাসরি জবাবদিহিমূলক একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আসে। তারা বেশিরভাগ সময় ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু যিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছিলেন তিনি কোনো কাজই করেননি। এবার এটা হতে পারবে না। আগেই তাদের জানিয়ে দেওয়া হোক যদি কোনো ধরনের ঘটনা ঘটে এ ব্যাপারে তাদের যদি কোনো অবহেলা পাওয়া যায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাতে তারা আগে থেকে সতর্ক থাকেন।

সংস্কারের প্রধান শর্ত হচ্ছে সবাই এটা গ্রহণ করবে বলে জানান মান্না। তিনি বলেন, ন্যূনতম ঐক্যের চেষ্টা তাদের করতে হবে। ভালো নির্বাচনের জন্য আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। যতদূর পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য করতে পারবো তত দূর পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে। বাকি যে ব্যাপার আছে আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে সেই সরকার করবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, পুরানো সিন্ডিকেট আবার যে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছি। তারা বলেছেন, চারটা কাজকে অগ্রাধিকারের মধ্যে নিয়েছেন, তার মধ্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখতে চাই মানুষ যেন এর সুফল পায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যাতে বন্ধ হয়।

নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় গণতান্ত্রিক বামজোট

সব সংস্কার করার দায়িত্ব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নয় জানিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সরকারের কাছে নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তুলেছেন।

সব সংস্কার করার দায়িত্ব এই সরকারের নয় মন্তব্য করে প্রিন্স বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। আজকে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট চায় ইসলামী আন্দোলন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন এনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি তুলেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল দাবি করে রেজাউল করিম বলেন, আমরা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে ভোট চেয়েছি। প্রতিটা ভোটারের ভোট মূল্যায়িত হবে। সব দল দলীয়ভাবে ভোট করবে। সরকার হবে জাতীয় সরকার। তারা আমাদের এই প্রস্তাবকে ভালো ভাবে নিয়েছে।

দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদে চার বছর মেয়াদ চায় গণঅধিকার পরিষদ

দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের পাশাপাশি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে এক বছর কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। গণ অধিকারের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আমরা ১২টি দাবি তুলে ধরেছি।

রাশেদ বলেন, আমরা বলেছি উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন তারা যোগ্য এবং দক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা যোগ্যতাসম্পন্ন লোক দরকার। আমরা দেখেছি দুই মাসেও রাষ্ট্রের পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। যেহেতু যথাযথভাবে সংস্কারগুলো করতে হবে, সে কারণে আমরা উপদেষ্টা পরিষদের পরিধি বাড়ানোর কথা বলেছি।

দেড়-দুই বছরের মধ্যে ভোট চায় আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি)

আগামী নির্বাচন করতে যে সব মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন তা করে আগামী দেড়-দুই বছরের মধ্যে ভোট চায় আমার বাংলাদেশ পার্টি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনী সময় দেয় সেই সময় রক্ষা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান দলটির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।

মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রতি আস্থা পাচ্ছে না কেউ। এখনো পুলিশ ভালোভাবে কাজ করছে না। মনোবল অনেক দুর্বল। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পরও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কাজ হতাশাজনক দাবি করে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে বলেছি। প্রয়োজনে এসব মন্ত্রণালয়ে নতুন উপদেষ্টা নিয়োগের কথা বলেছি।

শিক্ষা সংস্কার কমিটি নিয়ে ফের আপত্তি হেফাজতের

আলেমদের আপত্তির মুখে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন সংস্কার কমিটি নিয়ে আপত্তি উঠলে তা বাতিল করে সরকার। গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে গঠিত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজত ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক।

রাষ্ট্র সংস্কারে অনেকগুলো কমিশন গঠন হয়েছে জানিয়ে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রতিটি কমিশন আলাদা আলাদা করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবে, আলোচনার মাধ্যমে তারা তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করবে। সেই প্রস্তাবনা তৈরি হলে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করবে। তারপরই সবার মতামত নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা কাজ শুরু করবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বক্তব্য

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফার সংলাপ শেষে শনিবার (৫ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

এসময় প্রশাসনের ভিতরে যারা ফ্যাসিবাদের দোসর তাদের ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান আছে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয় আছে। ফ্যাসিবাদের যারা দোসর ছিল তাদেরকে কিভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায়। তারা যে অপরাধ করেছে সেই অপরাধ শাস্তির আওতায় আনার সরকারের স্পষ্ট অবস্থান আছে।

নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনী রোডম্যাপের ব্যাপারে যে আলাপটা হচ্ছে সেটা হচ্ছে, ছয়টা কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। বাকিটা দুই একদিনের মধ্যে ঘোষণা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ছয়টি কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে কথা বলবেন, তাদের তিনমাসের টাইমলাইনের মধ্যে। এরপর তিনমাসের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেবেন। প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবার উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা ন্যূনতম ঐক্যমতে আসবে। ঐকমতের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইনটা। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন নির্বাচনী কাজগুলো এগিয়ে যাবে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজগুলো এগিয়ে যাবে। কারণ যখন ঐক্যমতটা রিফর্মের ব্যাপারে রিচ হল, যাতে খুব দ্রুত নির্বাচনটা দিয়ে দেওয়া যায়।

তিনি বলেন, এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না। প্রসিডিউরটা কিভাবে হবে তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

দলগুলোর পক্ষ থেকে লিখিত অনেক প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, আমরা সবগুলো নিয়ে বসবো। প্রধান উপদেষ্টা অলরেডি বলেছেন আরও অনেকগুলো কমিশন হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলমান প্রক্রিয়া বলে জানান তিনি। বলেন, পলিটিক্যাল পার্টি এই সরকারের বড় ধরনের শরিক। এর আগে সংলাপ হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটা চলবে। পলিটিক্যাল পার্টি তাদের কনসার্নগুলো নিয়ে আসবেন। কথা হবে। এই প্রক্রিয়াটা চলতে থাকবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর