ছেলের মৃত্যুর পর কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়েই গিয়েছিল জোসনা বেগমের! বিলাপ করতে করতে গলার স্বরও বসে গিয়েছিল। একটা সাদা পাতায় ভর করে আসা ছেলের ‘সুখবর’ ফের স্যাঁতসেঁতে করে তুলল মায়ের দুই নয়ন। মন জুড়েও শুধুই হাহাকার, তোলপাড়। শোকের সাগরে ডুবে থাকা এই নারী, ‘শহীদ’ মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরামের মা। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে প্রাণ দেওয়া ওয়াসিমকে নতুন করে কি আর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? তার নামটা যে ছাত্র-জনতার মনের ভেতরে গেঁথে আছে বীর চট্টলার প্রথম শহীদ হিসেবে।
বুধবার (৯ অক্টোবর) ওয়াসিম আকরামের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন বুলেটের আঘাতে চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হয়ে যাওয়া ওয়াসিম। সেই খুশির খবরে কাঁদছেন ওয়াসিমের মা, কাঁদছে তার বন্ধুরাও।
উৎসবের বদলে ওয়াসিমের কক্সবাজারের পেকুয়ার বাঘগুজারা বাজারপাড়া এলাকার বাড়িতে এখন শোকের আবহ। ফোন দিতেই জোসনা বেগম বললেন, ‘ছেলের ফল দেখে একদিকে ভালো লাগছে, তবে মন খারাপ হচ্ছে বেশি। কেননা আমার ছেলেটাতো ফলটা দেখে যেতে পারল না। সে বেঁচে থাকলে আজ কত আনন্দ হতো, খুশি লাগতো। কিন্তু ছেলের সঙ্গে সব আনন্দই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন ছেলে হারানোর শোক আজীবন বুকে বয়ে বেড়াতে হবে।’
ছেলে আর মায়ের স্বপ্ন মিলে গিয়েছিল একই বিন্দুতে। ওয়াসিমের স্বপ্ন ছিল বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষক হবেন, মা-ও ছেলেকে ঘিরে দেখতেন একই স্বপ্ন। দীর্ঘশ্বাস চেপে জোসনা বেগম তাই তো বলেন, ‘সব মা-য় তো সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওয়াসিমকে ঘিরে সেই স্বপ্নটা আমার একটু বেশিই ছিল। কেননা বড় ছেলে বাবার সঙ্গে প্রবাসে ছিল। মেজ ছেলে ওয়াসিমকে ঘিরেই তাই আমার সব স্বপ্ন দানা বাঁধছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে বড় হয়ে শিক্ষক হবে, হবে মানুষ গড়ার কারিগর। ছেলেও ঠিক তাই চাইতো মনেপ্রাণে। ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে-এটাই এখন সান্ত্বনা।’
ঈদুল আজহার ছুটিতে বেশিদিন বাড়ি থাকা হয়নি ওয়াসিমের, পরীক্ষার কারণে দ্রুতই শহরে ফিরতে হয়েছিল। প্রতিটি পরীক্ষার আগেই মাকে ফোন দিয়ে দোয়া নিয়ে তারপর ঢুকতেন হলে। সেসব ভেবে ভেবে মায়ের মন আবারও ভিজে ওঠে। বলেন, ‘বাড়ির অদূরের কবরস্থানে মাটির নীচের ঘরে শুয়ে আছে ছেলেটা। মনে হয়, দীর্ঘ ঘুম থেকে উঠে ছেলে এখনি আমার কাছে ফিরে আসবে ফলের নম্বরফর্দ নিয়ে। সেটি দেখাতে দেখাতে আরেকবার বর্ণনা দেবে তার আর আমার স্বপ্নের কথা।’
ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিনেরও। ১০ম শ্রেণিতে পড়ুয়া পনেরো বছরের কিশোরী বলল, ‘অন্য সময় হলে ভাইয়ের এমন ফলের পর ঘরে মিষ্টির বন্যা বইতো। ভাইও হয়তো শহর থেকে গ্রামে ছুটে আসতেন। আর মাকে বলতেন তারই প্রিয় সব রান্না তৈরি করতে। কিছুই হলো না। আজ সবকিছু আছে, শুধু আমার ভাইটাই যে নেই।’
ওয়াসিম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে চট্টগ্রামে হওয়া প্রতিদিনের কর্মসূচিতে যোগ দেন ওয়াসিমও। ১৬ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব নির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। ওই তিন বেলা তিনটার দিকে ওয়াসিম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘চলে আসুন ষোলশহর’। তবে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ আগেই স্টেশন চত্বর দখলে নেয়। সংঘর্ষ এড়াতে শিক্ষার্থীরা এক কিলোমিটার দূরে মুরাদপুরে জড়ো হন। বিকেল পৌনে তিনটার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতারা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোঁড়েন। সেই গুলিতে ওয়াসিমসহ তিনজন মারা যান।
ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলম ও বড় ভাই আরশাদ আলী সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। তবে ওয়াসিমের মৃত্যুর পর ২০ আগস্ট তারা একেবারেই দেশে চলে আসেন।
ওয়াসিমের ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিন সেই কথা জানিয়ে বলেন, বাবাকে নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতেন ভাইয়া। বাবার বয়স বাড়ছে, তারপরও আমাদের জন্য প্রবাসে কষ্ট করতেন ,সেটি সহ্য হতো না ভাইয়ার। তাই বাবাকে বারবার ফোন দিয়ে বলতেন, ‘‘আব্বু চলে আসেন। আর কয়েকটা বছর। পড়ালেখা শেষ হলে চাকরিতে ঢুকে আমিই পরিবারের দায়িত্ব নেব।’’ আজ ঠিকই ভাইয়ার জন্যই বাবা দেশে চলে এসেছেন!’
ওয়াসিমের ফলের নম্বরফর্দটা ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। ওয়াসিমকে ভেবে বন্ধুদের মনও অশ্রুসিক্ত হচ্ছে বারবার। শোকের ওপর প্রলেপ দিয়ে কেউ কেউ অবশ্য লিখছেন, ‘ওয়াসিম, এই ফল তোর জন্য কিছুই না বন্ধু। তুই আরও বড় ফল পেয়েছিস। ‘বীর' খ্যাতি কি সবার কপালে জুটে?’