বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ লক্ষ্মীপুরের খালেদ মাহমুদ সুজন (১৯) তিন মাস ধরে শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে ৭টি গুলি। আন্দোলনে অংশ নিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ৯টি ছররা গুলি এবং একটি তাজা বুলেট বিদ্ধ হয় তার। তাজা বুলেটটি লিভারে গিয়ে বিদ্ধ হয়। আর ছররা বুলেটগুলো দুই হাতে, ঘাড়ে, বুকে কানের পাশ লাগে।
প্রথম দফায় অপারেশন করে তার শরীর থেকে তাজা বুলেট ও দুটি ছররা গুলি বের করা গেলেও এখনো রয়ে গেছে আরো ৭টি ছররা গুলি। গত তিন মাস ধরে শরীরে বুলেটগুলো নিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটছে সুজনের। তার শরীরের বাম অংশ প্যারালইজড হওয়ার পথে। অন্যের সাহায্য ছাড়া নড়াচড়া করতেও পারছেন না তিনি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশের কোনো হাসপাতালে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব ন।। সুস্থ জীবন পেতে হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন।
অভাবের সংসারে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ নেই তার পরিবারের।
সুজন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রসুলগঞ্জ বাজার সংলগ্ন তাজল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়ির শাহীন কাদেরের মেজো ছেলে।
তিন ভাইয়ের সংসারে সুজনের বড় ভাই ও তার বাবা শাহীন কাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ছোট ভাই শিহাব ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন সুজন। বর্তমানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘরবন্দী সুজনের পরিবারে আয়ের কোনো উৎস্য নেই। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজনের সহায়তায় আপাতত চলছে সুজনদের সংসার।
গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় খালেদ মাহমুদ সুজন। ওইদিন সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুর বাসভবনের চাদ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে টিপু ও তার সহযোগীরা। এতে চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আহত হয় অন্তত দুই শতাধিক।
সুজন জানায়, তিনি যখন ৯ম শ্রেণিতে পড়েন তখন থেকেই টুকটাক ব্যবসা করে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন। ২০২৩ সালে তিনি লক্ষ্মীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের আওতায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর শহরের পুরাতন আদালত সড়কে 'মা ফার্নিচার্স হাউজ' নামে একটি কোকারিজ দোকান চালান। তা দিয়েই চলতো তাদের সংসার।
তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতাম। ৪ আগস্ট সকালে আন্দোলন শুরু হলে আমি মাদাম এলাকা থেকে যোগ দিই। সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। এরপর এদিন শহরের তমিজ মার্কেটে থাকা সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান টিপুর বাসভবনের চাদ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে আমি গুলিবিদ্ধ হই। টিপু সরাসরি আমাকে গুলি করে। বেশকিছু ছররা গুলি আমার শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। একটি তাজা গুলিও আমার বুকে লাগে। আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার সাথে থাকা আন্দোলনরত আমার ভাইয়েরা আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সুজনের নিকটাত্মীয় মো. মোবারক হোসেন বলেন, গুলিবিদ্ধ সুজনকে হাসপাতালে দেখার মতো পরিবারের কেউ ছিল না। তাই আমি সদর হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্ত সদর হাসপাতালে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের হামলার আশংকায় সুজনকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে নোয়াখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওই হাসপাতালটি গুলিবিদ্ধ সুজনকে ভর্তি করেনি। পরে ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে অপারেশনের মাধ্যমে তার লিভার থেকে পিতলের বড় একটি গুলি (তাজা গুলি) বের করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তার শরীরে আরও সাতটি গুলি রয়ে গেছে। দেশের কোনো হাসপাতালে অপারেশন করেও গুলিগুলো বের করা সম্ভব নয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অপারেশনে তার প্রাণহানী ঘটতে পারে। তাই বিদেশে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
সুজন বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ দিন থাকার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সিএমএইচ হাসপাতালে অপারেশন করে আমার হাতের একটি গুলি বের করা হয়। সিএমএইচে চিকিৎসরা জানিয়েছে আমার শরীরে বর্তমানে যে ৭টি গুলি রয়েছে সেগুলো তারা বের করতে পারবে না। বিদেশে চিকিৎসার মাধ্যমে তা বের করা যেতে পারে। ৩০দিন পর আমি সিএমএইচ থেকে বাড়ি চলে আসি।
আমার ডান হাতে তিনটি, ঘাড়ের তেতরে একটি, বুকের ভেতরে দুটি, কানের নিচে একটি ছররা গুলি এখনো রয়ে গেছে। এগুলো নিয়েই আমাকে থাকতে হচ্ছে।
সুজন বলেন, আমার দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়ি ও গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছে। সংগঠন থেকেও সহযোগিতা করা হয়।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক জয়নাল আবেদিন জানান, সুজনের দেহের প্রতিটি গুলি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কোনো কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে নিশ্চিত প্রাণহানি ঘটতে পারে। দ্রুত তার শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা প্রয়োজন। এজন্য হয়তো বিদেশে নেয়া লাগতে পারে।
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি।