সিলেট থেকে: হযরত শাহ জালাল (রহ.), হযরত শাহ পরান (রহ.) এবং ৩৬০ জন পূর্ণাত্মা আউলিয়ার স্মৃতিধন্য পবিত্রভূমি সিলেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেকের নাম: শ্রী চৈতন্য দেব, হাসন রাজা, রাধা রমন, শাহ আব্দুল করিম। পাহাড়, নদী, হাওর-এ পরিপূর্ণ চা উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম এ স্থানটি 'একটি কুড়ি দুটি পাতার দেশ' নামেও সমধিক পরিচিত।
শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সিলেট পৌঁছে এই আধ্যাত্মিক নগরীর প্রাণচাঞ্চল্য টের পাওয়া গেলো। নগরের প্রাণকেন্দ্র দরগা গেট জমজমাট। ছুটির দিনের আলস্যের বালাই নেই কারো মধ্যেই। হোটেল, দোকানি, গণপরিবহণে ভিড়। দেশের বিভিন্ন স্থানে শত,শত গাড়িতে মাজার জিয়ারতে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। অসংখ্য গাড়ির জটলা দরগা গেট পেরিয়ে আশেপাশের আম্বরখানা, আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে।
'সিলেটে সব সময়ই জিয়ারতকারী ও পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য বন্ধের দিন ভিড় চার/পাঁচ গুণ বেড়ে যায়', বললেন দরগা হোটেলের কর্মকারী মজনু মিয়া। তার মতে, এসব দিনে থাকা ও খাওয়ার হোটেলে এবং যানবাহনে চাপ পড়ে বেশি।
সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মী হোসেন রাফসান স্বপনের সাথে দেখা হলো দরগার অনতিদূরে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সাহিত্য পরিষদের সামনে। নানা কথার পর তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেমন আছে সিলেট ও সিলেটবাসী?'
প্রথমে সাদামাটা উত্তর দিলেন তিনি, 'দেশের সবাই যেমন আছে, সিলেটও তেমনই আছে।'
'কিন্ত সীমান্তবর্তী ও প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। ফলে দেশের অন্য জায়গার চেয়ে এখানকার পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা হওয়ারই কথা', আমার প্রশ্ন শুনে স্বপন বললেন, 'কিছু পার্থক্য অবশ্যই আছে। তবে ক্ষমতার হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর বদল হয়েছে।'
তার কাছ থেকে জানা যায় যে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটের সীমান্ত এলাকাগুলোয় চোরাচালান অনেকটা বন্ধ থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা আবার সক্রিয় হয়েছে। চোরাকারবারের সিন্ডিকেট আগে ছিল ক্ষমতাসীনদের হাতে। সেগুলোর হাত বদল হয়েছে।
শহরের সূত্রগুলো মতে, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী শতাধিক স্থান দিয়ে চোরাই পণ্যের চোরাচালান হয়। পাশের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার সীমান্তও হটস্পট। সীমান্তের উভয় পাশেই চোরাকারবারি চক্র সক্রিয়। বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু ব্যবসায়ীর মদদে চোরাই পথের মালামাল বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে।
দুপুরের দিকে ভোলাগঞ্জ সীমান্তের দিকে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চোরাই পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসছে চিনি। চোরাকারবারি চক্রের সদস্য ও তাদের নিয়োজিত লোকজন সুযোগ বুঝে চিনির বস্তা সীমান্ত থেকে এনে কখনও নৌকা, মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা পুরো জেলায় ছড়িয়ে দেয়। সীমান্তে নৌকায় শুধু পর্যটন আনা-নেওয়া হয় না, চোরাকারবারেও ব্যবহৃত হয়।
তাছাড়া, প্রসাধনসামগ্রী, কাপড়, মাদক, আপেল, কম্বল, গরুসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যও আসছে। সরকার বদলের কারণে কিছুদিন চুপ থাকলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতা নিয়ে তারা আবার সক্রিয় হয়েছে।
রাতে উপশহরে যাওয়ার পথে সিএনজি চালক সুজন মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তার কাছে শহরের হালচাল জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আগের অবস্থা আবার ফিরে আসছে। স্ট্যান্ড ও রুট চাঁদা দিতে হচ্ছে। তবে এখন চাঁদা নিচ্ছে আরেক পার্টি।'
স্থানীয় সূত্রের মতে, যানবাহন, বস্তি ছাড়াও জলমহাল, বালুমহাল, পাথর উত্তোলনে চাঁদাবাজ ও দখলদারদের দৌরাত্ম্য আবারও বেড়েছে। এসব কাজে পুরাতন নেতাদের অনেকেই ক্ষমতাহীন হয়ে পলাতক হওয়ায় নতুনরা সেসব জায়গা দখল করেছে। এক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দিতেই তুলছেন স্থানীয় লোকজন। এখন তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চোরাচালান চালু রয়েছে, এমন অভিযোগ করেছেন অনেকেই।
মানুষের অভিযোগ যে বহুলাংশে সত্য, তারও প্রমাণ রয়েছে। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, চোরাচালানে জড়িয়ে এরই মধ্যে বিএনপির দুই নেতা বহিষ্কৃত হয়েছেন। চোরাচালানের পণ্যসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন এক ছাত্রদল নেতার ভাই। অনেকের মতে, বিএনপির ত্যাগী ও আদর্শবাদী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে শক্তিশালী হচ্ছে চোরাকারবার ও দখলদারিতে সক্রিয় অসৎ নেতৃত্ব। তাদের কারণে সিলেটে দলের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে এবং সর্বত্র হাত বদল হয়ে চোরাচালান ও দখলদারিত্বের বিস্তার ঘটছে। ফলে রাজনীতি বা সামাজিক সমস্যা নয়, চোরাচালান ও দখলের হাত বদল সিলেটের হট ইস্যু।