রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের তবলা বাদক ছিলেন কৌশিক হোসেন তাপস। একসময়ের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কর্মচারী থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজেই একটি বেসরকারি চ্যানেল ‘গান বাংলা’র চেয়ারম্যান বনে যান তিনি। কিন্তু হঠাৎ এমন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার বিষয়টি নজর এড়িয়ে যায় সবার।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সু-সম্পর্ক এবং মন্ত্রীদের সাথে নিয়মিত ওঠা বসার কারনেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তিনি। গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পতনের পরে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে বেসরকারি চ্যানেল গান বাংলা চেয়ারম্যান কৌশিক হোসেন তাপস-এর অপকর্মের তথ্য।
গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে সুনিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় কৌশিক হোসেন তাপসকে।
মামলার সূত্রে জানা যায়, ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য ইশতিয়াক মাহমুদসহ অন্যরা ছাত্রজনতার সাথে একত্রিত হয়ে উত্তরা পূর্ব থানাধীন ৪নং সেক্টরস্থ আজমপুর নওয়াব হাবিবুল্লাহ হাই স্কুলের সামনে ফাঁকা রাস্তার উপর পৌঁছামাত্র ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ক্যাডাররা দেশী ও বিদেশী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ইশতিয়াকের উপর অতর্কিত হামলা, মারধরসহ গুলি বর্ষণ করতে থাকে। আসামিদের ছোড়া গুলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনিসহ ছাত্রদের অভিভাবক ও ছাত্রজনতা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পরে আসামিদের ছোড়া গুলি তার পেট, পিঠ, হাতে ও মাথায় লাগলে তিনি গুরুতর আহত হয়। পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
এ ঘটনায় গত ২৯ অক্টোবর ব্যবসায়ী ইশতিয়াক মাহমুদ বাদী হয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ১২৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারনামীয় ৯ নং আসামি হলেন তাপস।
জানা গেছে, গায়ক, সুরকার আবার কখনো সংগীত পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেয়া তাপসের প্রতিষ্ঠানে রাতভর চলত আড্ডা, গান ও নানা আয়োজন। সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীদের সেই আড্ডার মধ্যমণি হতেন তাপস ও তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী। মন্ত্রী ও আমলাদের খুশি রাখতে কথিত মডেল ও সুন্দরী নারী ছিলো তার হাতিয়ার।
জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সব সংস্কৃতি অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব থাকত তার হাতে। যার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান অন্যতম। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে বিদেশ থেকে নামি দামি শিল্পী আনার মাধ্যমে পাচার করতেন অর্থ।
অভিযোগ আছে, গান বাংলার তাপস ও তার বিউটিশিয়ান স্ত্রী মুন্নী মিলে বিপুল পরিমাণ টাকা লন্ডনে পাচার করেছেন। দেশের বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান আয়োজনে বিদেশি শিল্পী আনার নামে এই সব টাকা পাচার করেন তারা। ফলে বিদেশের মাটিতেও এখন অঢেল সম্পদের মালিক এই তাপস। বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি কেনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার বিনিয়োগ রয়েছে। যার দেখভাল করেন তার কথিত মেয়ে নাজিস আরমান ও তার স্বামী সালমান বেগ। মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে দিয়ে দেশ থেকে পাচার করা কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছেন তাপস।
এর আগে ২০২২ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা ও দেশের ইসলামি দলগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নীল সিনেমার নায়িকা ও বর্তমানে বলিউড অভিনেত্রী সানি লিওনকে ঢাকা আনেন তাপস। সেসময় তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে জানানো হয়েছিল, সানি লিওনের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু মেয়ের বিয়েতে এই বলিউড তারকাকে নাচাবেন বলে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই ঢাকায় সানি লিওনকে নিয়ে আসেন তাপস। ১৩ ঘণ্টার সফর শেষে কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই দেশ ছাড়েন এই অভিনেত্রী।
জানা গেছে, তাপসে স্ত্রী মুন্নীর আগের সংসারের মেয়ে নাজিস আরমান লন্ডনে বসবাস করেন। নাজিস আরমান কাজ করছেন পতিত সাবেক সরকার প্রধানের মেয়ে পুতুলের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন।
প্রশাসন ও মন্ত্রীদের ব্যবহার করে তাপস শুধু প্রভাব অর্জন করেন নি। তার এই প্রভাব ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের বহু মানুষের সঙ্গে। অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ পরিচালক তাপসের প্রতারণা ও উত্থানের বিষয়ে বলেন, তাপসকে আমি ২০০৮ সাল থেকে চিনি। সে একটা সময়ে কারওয়ান বাজারে একটি টেলিভিশনের তবলা বাদক ছিলো। তাপস অনেক চালক মানুষ। তার মূলত দুটি হাতিয়ার। একটি হলো মানুষকে কনভেন্স করা ও অপরটি হলো তার নারী সাপ্লাই। সে গানটা ভালো গাইতে পারে। এতেই তার এতো ক্ষমতা অর্জন হয়েছে।
এদিকে তাপসের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা পূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মুহিববুল্লাহ বার্তা২৪ কে বলেন, তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে, তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
এদিকে তাপসের মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গান বাংলা চেয়ারম্যান কৌশিক হোসেন তাপসের বিরুদ্ধে অনেক তথ্যই মিলছে। বিশেষ করে তার বিদেশে সম্পদের বিষয়ে। তবে বিদেশে টাকা পাঠানো বা মানিলন্ডারিং বিষয় সিআইডি দেখে। আমরা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলে সিআইডিকে অবগত করব।