সুই-সুতা নিয়ে ব্যস্ত ‘টুপি’ তৈরির কারিগররা

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর | 2023-08-31 00:08:51

নিপুণ হাতের স্পর্শে কারুকাজ খচিত টুপি তৈরিতে ব্যস্ত আরজিনা। তাই সুই-সুতা থেকে তার চোখ যেন সরছেই না। আপন মনে টুপির উপর নকশা তৈরি করছেন। ঈদকে ঘিরে আরজিনার মতো ব্যস্ত সময় পার করছেন টুপি শিল্পে জড়িত রংপুর অঞ্চলের কয়েক হাজার নারী।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দি গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এখানকার বাড়িতে বাড়িতে নারীরা তৈরি করছেন বাহারি নকশার কারুকাজ খচিত দৃষ্টিনন্দন টুপি। দামি কাপড়ে বাহারি ডিজাইনে তৈরি এসব টুপি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

দিনরাত টুপি তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় যেন দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। এই টুপি তৈরি করেই আজ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে এক সময়ের অভাব অনটনে থাকা দরিদ্র নারীরা। পাল্টে গেছে তাদের জীবনচিত্র। সংসারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। লেখাপড়া করে শিক্ষিত হচ্ছে তাদের সন্তানরাও।

এ অঞ্চলে বর্তমানে বেকার দুস্থ নারীদের নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়াই বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ছোট ছোট কারখানা দিয়ে চালাচ্ছেন টুপি শিল্পের এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। এতে করে কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছে এক সময়ের মঙ্গা কবলিত তিস্তা পাড়ের হতদরিদ্র হাজার হাজার নারী। এখন কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নারীরা টুপির কারিগর হিসেবে বেশ পরিচিত। পিছিয়ে নেই রংপুর অঞ্চলের অন্য জেলার নারীরাও।

কাউনিয়া উপজেলার সাব্দি গ্রামের টুপির কারিগর মিনারা বেগম, কদ বানু ও সানজিদা বার্তা২৪.কমকে জানান, একটি টুপি তৈরিতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন। মাসে গড়ে তারা ৩টি করে টুপি তৈরি করেন। প্রতিটি টুপিতে নির্দিষ্ট নকশা ও সাইজ অনুযায়ী ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান।

একই উপজেলার খোর্দ্দ ভুতছড়া গ্রামের টুপি শ্রমিক শামসুন নাহার ও রেহেনা বেগম গত ১০ বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। তাদের একেকজনের মাসিক আয় দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা।

জানা গেছে, ২০০২ সালে শহীদবাগ ইউনিয়নের খোর্দ্দ ভুতছড়ার হতদরিদ্র ফরিদ উদ্দিনের স্ত্রী শহিদা বেগম প্রথম এই টুপি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। তার সেই তৈরি টুপি ঢাকার এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর পছন্দ হলে সেখান থেকে শুরু হয়ে শহিদার বদলে যাবার গল্প। একই সঙ্গে বদলে যেতে থাকে এই গ্রামের বেকার দরিদ্র নারীদের জীবনগল্পও। দ্রুত সময়ের মধ্যে খোর্দ্দ ভুতছাড়াসহ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে টুপি ও শাহিদার উত্থান কাহিনী।

পরবর্তীতে এভাবেই ভুতছাড়া, পার্শ্ববর্তী বল্লভবিষু, শিবু, রামচন্ডীপুর, শাহবাজ, বেটুবাড়ি, পূর্বচাঁদঘাট, পশ্চিমচাঁদঘাট, বখসি পাড়াসহ এখন গোটা কাউনিয়া উপজেলাই পরিণত হয়েছে টুপির কারখানায়।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পাকিস্তানি টুপি শীর্ষস্থান দখল করে রাখলেও রংপুর অঞ্চলের দৃষ্টিনন্দন বাংলাদেশি টুপি ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি ও বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।

রপ্তানিযোগ্য এ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে শহীদবাগের সাব্দি গ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকেই। তাদের একজন জহিরুল ইসলাম জহির। যিনি ওমান থেকে তার স্ত্রীকে নিয়মিত দিক নির্দেশনা দিয়ে টুপি রপ্তানির ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।

বেকার ও দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই টুপি শিল্প সচ্ছলতার পথ খুলে দিয়েছে বলে মনে করেন জহিরের স্ত্রী ফারজানা শারমিন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কর্মী ও এজেন্টদের মাধ্যমে আমরা টুপি তৈরি করে নিচ্ছি। কর্মীদেরকে বাড়ি বাড়ি সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। প্রতি পিস টুপিতে নকশা করার জন্য তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকেন।’

তিনি আরও জানান, প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টুপি ওমানে পাঠানো হচ্ছে। মান, আকার ও প্রকারভেদে একেকটি টুপি তৈরিতে খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব টুপি ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

এই টুপি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মনে করছেন সরকারিভাবে সহায়তা পেলে হস্তশিল্পের আরও সম্প্রসারণ করতে পারবেন তারা। একই সঙ্গে রপ্তানিখাতে বাড়বে আরও বেশি বৈদেশিক অর্জন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর