থমকে আছে রাজধানীর খাল উদ্ধার, জলাবদ্ধতা চরমে

ঢাকা, জাতীয়

আবু হায়াত মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-30 23:10:54

প্রতি বছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পায়নি রাজধানীবাসী। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু সমান পানিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর উভয় সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ সড়ক। আবার মহানগরীর পার্শ্ববর্তী নিচু এলাকাগুলোতে জমে যাচ্ছে কোমর সমান পানি।

ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা নতুন কোনো সমস্যা নয়। প্রায় তিন দশক ধরে নগরীর খালগুলো বেদখল হওয়ার কারণে এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

রাজধানীর খাল উদ্ধারে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন নগরবাসী বহু আন্দোলন করেছে। উন্মুক্ত জলাধার খাল ও নদ-নদী রক্ষা ও উদ্ধারে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও রয়েছে । এসব নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা), ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি), এবং বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক অভিযান চালায় বলে দাবি করে।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট এসব কর্তৃপক্ষের দাবির কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না বর্ষা মৌসুমে। জলাবদ্ধতা লেগেই আছে। তবে এ জলাবদ্ধতাকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে জলজট বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ওয়াসার এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক খালগুলো সিটি কর্পোরেশনের অধীনে নিয়ে দখলমুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আনিসুল হকের প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছিলো ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও।

পরবর্তীতে আরো একটি প্রস্তাবনা আসে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খালগুলো দখলমুক্ত ও পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে আনিসুল হকের আকস্মিক মৃত্যুতে থমকে যায় সব উদ্যোগ। এখনেই আড়ম্বরপূর্ণ অভিযানের ডিএনসিসি,  ডিএসসিসি ও ওয়াসা কারো মধ্যেই দেখা যায় না।

নগর পরিকল্পনাবিদ, ইতিহাস ভিত্তিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা গেছে রাজধানী ঢাকায় এক সময় ৬৩ টি খাল প্রবাহিত ছিলো। এখন থেকে তিন দশক আগেও এ সংখ্যা ছিলো ৫০ টির বেশী। তাছাড়া নগরীর চতুর্দিকে চারটি নদী ও ব্যাপক উন্মুক্ত জলাধার ছিলো।

কিন্তু অবৈধ দখলের কারণে খালের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২৬ টিতে, তাও আবার বেদখলে হয়ে গেছে নালার মতো। তাছাড়া চারটি নদ-নদী তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যাও এবং এসব নদীর তীরবর্তী বন্যা বিধৌত এলাকা ও উন্মুক্ত জলাধারও বেদখলে বেহাল দশা।

রাজধানীর বৃষ্টির পানিও পয়:নিষ্কাশনের প্রধান প্রবাহ বা গতিপথ হচ্ছে ২৬ টি খাল। এর মধ্যে প্রধান খালগুলো বিশেষ করে দ্বিগুণ, ইব্রাহীমপুর ও কল্যাণপুর খালের প্রবাহ গিয়ে মিলিত হয়েছে তুরাগ নদে। ধানমন্ডি লেক, পরিবাগ খাল, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক ‍ও হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের প্রবাহ গিয়ে পড়েছে বালু নদীতে। সেগুনবাগিচা, জিরানী ও ধোলাইখাল গিয়ে পড়েছে বালু ও বুড়িগঙ্গা নদীতে। তাছাড়া অন্যান্য খাল এবং ধারা-উপধারাগুলো এসব প্রধান খালের সঙ্গে সংযুক্ত।

এই ২৬টি খালের মালিকানা ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের। তবে এখনও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ওয়াসা। বাকী সকল খাল বিলীন হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে বেদখল, সড়ক নির্মাণ, বক্স কালভার্ট এবং ড্রেন ও পয়:নিষ্কাশন লাইন নির্মাণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা ওয়াসার ২০১০ সালের এক জরিপ প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে বেদখল হওয়া খাল অবৈধভাবে গত তিন থেকে চার দশকে দখল করে নেয় প্রায় ১০ হাজার ৫০০ রাজনৈতিক ক্ষমতাধর দখলদার। যাদের অনেকেই এখন ভূমিদস্যু বলে পরিচিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খালগুলো বেদখল ও বিলীন হওয়ার কারণেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতা তীব্র রূপ নিতে শুরু করেছে। যে ২৬ টি খাল আছে সেগুলোও এখন প্রায় নর্দমায় রূপ নিয়েছে। পরিদর্শন ও ঢাকা ওয়াসার নথি থেকে দেখা গেছে দেখা গেছে মিরপুর রূপনগর খালের প্রস্থ ৩ থেকে ৮ মিটার, ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্য বাইশটেক খালের প্রস্থ ৩০ মিটার, ২.৪ কিলোমিটার সাংবাদিক কলোনীর খালের প্রস্থও ২০ মিটারের বেশী হবে না, সেকশন ১৪ এর হাউজিং খালের দৈর্ঘ্য কমে ১.১ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ৮.৮ কিলোমিটার বাউনিয়া খালের প্রস্থ ১০ থেকে ১২ মিটার, ৪.৫ কিলোমিটার দ্বিগুণ খালের প্রস্থ ৫০ মিটার এবং ইব্রাহীমপুর খালের দৈর্ঘ্য ১.২ কিলোমিটার।

ঢাকা ওয়াসার ২০০৭ সারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২.২ কিলোমিটার কল্যাণপুর প্রধান খালটি ছিলো ১৮ থেকে ৩৬ মিটার প্রস্থ। কিন্তু এটির দুই পাড় দিয়ে দখলদারদের অবৈধ দখল ও ভরাটে এটির প্রস্থ কমে এখন আছে ১০ থেকে ১২ মিটার। এছাড়াও এই খালটির আরো পাঁচটি শাখা খালেরও অবৈধ দখলে প্রস্থ কমে এখন নর্দমায় পরিণত হওয়ার পথে। এমন অবস্থা শুধু কল্যাণপুর খালের ক্ষেত্রে নয়, বাকী খালগুলোরও একই হাল।

এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ওয়াসা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করা ওয়াসার রুটিন কাযর্ক্রম প্রতিনিয়তই চলছে। তবে অনেকক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

তবে রাজধানীর খাল ও জলাধার বেদখলে উদ্যোগ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বৃহস্পতিবার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ মিলনায়তনে মৎস্য সপ্তাহ ২০১৯ এর উদ্বেধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, খাল, পুকুর ও নদীসহ অন্যান্য যত জলাধার বেদখল হয়ে আছে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর অধীস্থ ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেন রাজধানীর খাল ও অন্যান্য জলাধারগুলো পুনরুদ্ধার করার। কিন্ত এ সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বৃহৎ ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর