নরসিংদী জেলার চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদী। এর শাখা নদীগুলোর মধ্যে- ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, হাড়ি-দোয়া নদী, পাহাড়িয়া, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র অন্যতম। এসব নদ-নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠছে নরসিংদীর শিল্পাঞ্চল। কিন্তু দখল আর দূষণে বর্তমানে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এসব নদ-নদী।
জানা গেছে, নদীপথে যাতায়াতের সহজলভ্যতার কথা চিন্তা করে পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় কারখানা। ফলে এই কারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি নদীতে মিশে ভরাট হচ্ছে। আর বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো পানিতে থৈ থৈ করলেও অন্য সময়ে পানি অনেক কম থাকে।
জানা গেছে, এসব নদী দিয়ে এক সময় বড় বড় জাহাজ আর পাল তোলা নৌকা চলতো। ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে নরসিংদীতে ছুটে আসতেন নদীপথেই। সেই থেকে নরসিংদীর এসব নদীর তীরে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকায় নদী সংকুচিত হতে থাকে। ফলে এখন বছরের বেশির ভাগ সময়ই নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নৌকাও চলে না। তাছাড়া কারখানার বর্জ্য মিশে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মাত্রা কম থাকে। এ কারণে এই নদীতে মাছ বাঁচে না।
সরেজমিনে দেখা গেছ, শিবপুর উপজেলার বড়ই তলা এলাকায় কয়েকটি কারখানার বর্জ্য গজারিয়া ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়া আন্ডারলাইন দিয়ে হাড়িধোঁয়া নদে পরে। এছাড়া নরসিংদীর সর্ববৃহৎ শিল্পনগরী বিসিক (আমতলা) এলাকার একটি গার্মেন্টসসহ শতাধিক শিল্পের বর্জ্য দড়িচর ব্রিজের পাশ দিয়ে নদীতে পড়ে। আর ভেলানগর ব্রিজের নীচ দিয়ে হাড়িধোঁয়ায় পরে বেশ কয়েকটি কারখানার বর্জ্য। ঘোড়াদিয়া ব্রিজ, হাজিপুর ব্রিজের নিচ দিয়ে বেশ কয়েকটি কারখানার বর্জ্য এ নদে এসে মিলিত হয়। এছাড়া শীতলক্ষ্যার পানিতে সার কারখানার ক্যামিকেল ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি পড়ায় মাছ বাঁচতে পারে না।
নরসিংদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, নরসিংদী শহরের উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদের ডিওর মান কমেছে। ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের অপরিকল্পিত বর্জ্য ও কেমিকেল মিশ্রিত পানি নিয়ন্ত্রণ করে ডিওর মান উন্নয়ন করা সম্ভব। গত মে ও জুনে ডিওর মাত্রা ছিল শূন্য দশমিক ৮/৯ মিলিগ্রাম/লিটার, জুলাইয়ে ২ দশমিক ১/২ এবং আগস্টে ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম/লিটার।
নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম মোস্তাফা মিয়া জানান, জনসংখ্যার আধিক্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত পানিপ্রবাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলোতে দূষণের মাত্রা বাড়ছে।
একই কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান জানান, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা এর বেশি থাকা প্রয়োজন। এরনিচে হলে প্রাণি বা কোনও উদ্ভিদ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
তিনি আরও জানান, পানিতে ডিওর মাত্রা প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেলে পানিতে শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায় না। আর ৮০ ভাগ মাছ শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। তাই ডিওর মান কম হলে ছোট ছোট মাছ মারা যায়। ফলে প্রাণীবৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়। হাড়িধোয়া নদে বছরের বেশির ভাগ সময়ই দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম থাকে। বর্ষায় কিছুটা বাড়লেও তাতে কিছু শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া ও কই, টাকি প্রজাতির মাছ ছাড়া অন্য কোনও মাছ ও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।
নরসিংদী পরিবেশ আন্দোলন (আপন) এর সভাপতি মইনুল ইসলাম মীরু জানান, নদ-নদীর দূষণ আর দখল নিয়ে একাধিকবার মানববন্ধন, সভা, সেমিনার ও প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো অনেকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন।
নরসিংদীর ১০০ শয্যা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. একরামুল ইসলাম শামীম জানান, নদীর দূষিত পানিতে নামলে শরীরে খাঁজলী, পাচড়া, চর্মসহ বিভিন্ন রকমের রোগ দেখা দিতে পারে।
নরসিংদী পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্য মতে, মেঘনা নদীটির ৪৫ কিলোমিটার নরসিংদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এরমধ্যে ভৈরব ও নরসিংদী অংশে নদীটির প্রস্থ হচ্ছে ১৫শ’ মিটার ও গভীরতা ২৫ মিটার। বর্ষাকালে এই নদী দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১৬ হাজার ৫৬৮ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহিত হয় ১০৫ ঘনমিটার।
আর মেঘনার নরসিংদী অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে প্রভাবশালীরা। এদের কেউ কেউ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আবার কেউবা সরাসরি রাজনীতি করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাননা। প্রভাবশালীরা মেঘনার একটি অংশ দখল করে গাছের ডালপালা ও বাঁশের কঞ্চি ফেলে মাছের ঘের তৈরি করে। ফলে নদীপথে নৌকা, লঞ্চ, স্পিডবোটসহ অন্যান্য নৌযান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। তাছাড়া নদীর দুই তীরের জেলে পরিবারে নেমে এসেছে দুর্ভোগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র চক্রবর্তী জানান, ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৫০০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নরসিংদীর ৬টি নদী খনন কাজ চলছে।