বুলিংয়ে স্তব্ধ শিশু, কী হচ্ছে আইএসডিতে!

ঢাকা, জাতীয়

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 19:06:08

১৪ বছরের একজন শিশু নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। প্রাণোচ্ছল, ওরিগামি নিয়ে মেতে থাকা শিশুটি স্কুলেও নিজের মতো থাকতে পছন্দ করত। অন্যদের দুষ্টুমিকে সবসময় সহজে মেনে নিতে পারতো না। এ নিয়ে সহপাঠী বন্ধুরা তাকে বুলিং করতে শুরু করে। শিশুটির শরীরের আকার এবং ত্বকের রং নিয়ে তাকে খ্যাপাতে থাকে। বিমর্ষ হয়ে পড়ে শিশু সুমি (ছদ্মনাম)।

ঢাকার নামীদামি স্কুলগুলো থেকে এভাবেই ঝরে পড়ছে সুমির মতো কোমলমতি শিশুরা। স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে, ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই স্কুলগুলোতে নিতে হবে এন্টি বুলিং পলিসি। কারণ, নগরায়ণের ফলে স্কুল ছাড়া বাচ্চাদের খুব বেশি সামাজিক সংযোগ ঘটানোর সুযোগ থাকে না। আর সেখানে নিশ্চিত করতে হবে শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ।

গত শনিবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকাকে (আইএসডি) সন্তানের মানবিক এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য দায়ী করে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন সুমির অভিভাবক। অভিভাবকের পক্ষে ব্যারিস্টার হাসান আজিম এই লিগ্যাল নোটিশ পাঠান স্কুলের ডিরেক্টর টিজে কোবার্নকে।

শুধু এই অভিভাবকই নন আর আইএসডি স্কুলসহ দেশের নামীদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ নতুন নয়। কোটি কোটি টাকা নিয়েও শিক্ষার্থীদের একটি নিরাপদ পরিবেশ স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রদান করতে পারছে না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।

এই কেস স্টাডিটিই ধরা যাক। অভিভাবকের অভিযোগ, সপ্তম গ্রেডে থাকা সুমির শরীরের আকার, ওজন এবং ত্বকের রং নিয়ে তার সহপাঠীরা উত্যক্ত করত। একসময় হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে সে। সাঁতারের ক্লাস ও শরীর চর্চার ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেয় সুমি। নিজেকে গুটিয়ে নেয় অন্যদের কাছ থেকে। এমনকি পরিবারের কাছ থেকেও। শিশুটিকে তার সহপাঠীরা এমন ধরনের প্রশ্ন করে যে, সে তার আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে যায়। নিজের মধ্যে চলতে থাকা দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বাবা-মাকে প্রশ্ন করে! আত্মহত্যার পথেও চলে যেতে চায় এই শিশুটি।

কথা হয়েছে সুমির অভিভাবক সালমা খানমের সঙ্গে। সন্তানের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া এই বিপর্যয়ে তিনিও বিধ্বস্ত মানসিকভাবে। বললেন, ‘আমি বারবার স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। সরাসরি দেখা করে অভিযোগ করেছি। ই-মেইলে বিষয়টি জানিয়েছি। বলেছি আমার বাচ্চার বিষয়ে একটু নজর দিতে এবং যে সহপাঠীরা উত্যক্ত করছে, ওদেরকেও কনসালটেন্সি করানোর জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু স্কুলের হেড অব সেকেন্ডারি ইলডিকো মুরে কোনো ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিয়ে আমার সন্তানকে অন্য স্কুলে বা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে বললেন। আমার মেয়ের সামনে এই ধরনের ব্যবহারে সে আরও বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’

এখন কী অবস্থা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্কুল পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আমার মেয়ের মনে স্কুল সম্পর্কে ভীতি কাজ করছে। স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে রওনা করে, আবার দেখা যায় লিফটের সামনে যেয়ে ফিরে আসছে। স্কুলের ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ওর ভয় কাটিয়ে ওঠানোর জন্য আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছি।’

শুধু সুমি নয়, আইএসডি স্কুল থেকে গত বছরই নবম গ্রেডের একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবক বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানান, এরইমধ্যে আইবি এক্সামের জন্য ওই শিশুর নিবন্ধন হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকার কোনো স্কুলেই ওই সময় শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা যায়নি। ফলে শিক্ষার্থী ও নিজের পুরো পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে হয়। আইএসডি নিজেদের দোষ আড়াল করতে তার সন্তানকে বহিষ্কার করে! আইএসডি সমস্যার সমাধান না করে বা শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং না করে উল্টো তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে।

এই বিষয়ে ব্যারিস্টার হাসান আজিম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘বুলিং বাচ্চাদের মনে বিরুপ প্রভাব ফেলে, যা অনেকদিন পর্যন্ত মনে গেঁথে থাকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এন্টি বুলিং নীতি থাকতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এর রূপ হবে র‌্যাগিংয়ের মতো ভয়াবহ ঘটনা। এক্ষেত্রে বুলিং যারা করছে এবং যারা শিকার হচ্ছে, এই সব শিশুকেই কাউন্সিলিংয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।’

গত বছরই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী শিশু অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল অভিভাবককে তার সামনে অপমান করায়। এখানে হেড অব সেকেন্ডারি ইলডিকো ওই একই অপরাধটি করেছেন। সন্তানের সামনে বাবা মায়ের কাছে নালিশ করেছেন। যেখানে শিশুরা নিজেদের অপরাধী ভাবতে শুরু করে এবং আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। অথচ এখানে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই শিশুটির পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল। এই স্কুলের বিরুদ্ধে আগেও এই ধরনের অভিযোগ ছিল বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান।

তিনি আরও বলেন, ‘বুলিং একটি অপরাধ। এর প্রতিকার না করে যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেটি পরবর্তীতে বড় আকার ধারণ করে। বুলিংকারী শিশুটিই বড় হয়ে র‌্যাগিং দেওয়ার চর্চা করবে। অপরাধী হয়ে উঠবে আর ঘটবে আবরার হত্যার মতো অপরাধ।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর