কামরুন নাহার মনি, নুসরাত হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ‘নুসরাত কিলিংমিশনে’ অংশ নেন। নুসরাত হত্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারেই ঠাঁই হয় অন্তঃসত্ত্বা মনির। এরপর তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। গত ২৪ অক্টোবর কন্যা সন্তান কোলে নিয়ে আদালতে ফাঁসির রায় শুনেছেন নুসরাত হত্যার অন্যতম এই আসামি। শুধু নিজেই এই রায় শোনেননি, রায় শুনেছেন তার এক মাস বয়সী নবজাতকও।
গত ২০ সেপ্টেম্বর মনির প্রসববেদনা উঠলে কারা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ফেনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কন্যা সন্তানের মা হন মনি। হাসপাতালে দুইদিন বাবা-মাসহ পরিবারের সান্নিধ্য পায় শিশুটি। এরপর থেকে মায়ের সঙ্গে কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে দিন কাটছে শিশুটির।
শিশুটির নাম রাখা হয় মোবাশিরা খানম রথি। মনির স্বামীর দাবি, নুসরাত জাহান রাফির নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছে। যদিও মনি তার মেয়েকে ডাকেন ‘রোজা’ নামে।
নুসরাত হত্যায় মনির ভূমিকা সম্পর্কে পিআইবি‘র তদন্তে জানা যায়, মনি হত্যার জন্য বোরকা ও হাতমোজা কেনেন। ঘটনার সময় নুসরাতের হাত বাঁধেন এবং চেপে ধরেন।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্তার কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজাও শুনেছেন। জেল বিধি ৯৯৪ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত স্ত্রীলোককে গর্ভবতী বা দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় পাওয়া গেলে হাইকোর্টবিভাগ দণ্ড স্থগিতের আদেশ দিতে পারেন। অথবা উপযুক্ত মনে করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারবেন। তবে মনি নবজাতকের মা হিসেবে আপিল বিভাগের রায়ে কতটা সুবিধা পাবেন তা সময়ই বলে দেবে।
তবে নিজের ‘অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে সন্তানকে জড়াতে’ চান না মনি। চান না, কারা দেয়ালের ভেতরে বন্দী অবস্থায় বেড়ে উঠুক তার মেয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে- কারা ফটকে দেখা করতে গেলে মনি তার পরিবারকে বলেন, ‘জন্মের পর থেকে মেয়েটা তার বাবা ও পরিবার কিছুই পেল না। আমার কারণে মেয়েটি পরিবার থেকে আজ বিচ্ছিন্ন। আমি ওকে কারাগারে রাখতে চাই না। আমি ওকে আমার কাছ থেকে মুক্ত করে দেব। আমি চাই সে তার বাবার কাছে চলে যাক। আমার সাজা আমি সন্তানকে দিতে চাই না’।
কারাগার সূত্র বলছে, জেল কোড ৯৫৭ ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড অবস্থায় কোন মা যদি সন্তান প্রসব করে। চাইলে সে সন্তান ৪ বছর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে কারাগারে থাকতে পারে। তবে জেল সুপার চাইলে আরো দুই বছর অর্থাৎ মোট ৬ বছর শিশুটি কারাগারে থাকতে পারবে।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে যে ধারণ ক্ষমতা, তার বেশি বন্দী থাকেন। এর মধ্যে একটি বড় অংশই নারী বন্দী। এই নারী কয়েদীদের অনেকের সাথেই তাদের শিশু সন্তানরাও থাকছে কারাগারের উঁচু ফটকের ভেতরে। কারাগারগুলোতে শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য নেই পর্যাপ্ত আলো বাতাস, বিনোদনের ব্যবস্থা।
ফেনী জেলা কারাগার-১ এর আলো-বাতাসহীন সাধারণ মহিলা ওয়ার্ডের একটি কক্ষে মায়ের সঙ্গে রয়েছেন শিশু রথি। যেখানে বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত নারী বন্দীরা রয়েছেন।
বন্দী মায়ের সাথে বন্দী দশায় থাকা শিশু রথী সঠিক খাবার পাচ্ছে কিনা, তার চিকিৎসা হচ্ছে কিনা, মানসিক বিকাশ ও তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে?-অন্যদিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর সমাজ শিশুটিকে কিভাবে গ্রহণ করবে? কবে সে পৃথিবীর আলো-বাতাস পাবে? এসব প্রশ্নও থেকে যায়, হয়ত সময়ই একদিন তার উত্তর দেবে।
যদিও ফেনী জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার মনির হোসেন দাবি করেন, মনির সন্তানের কারাবিধি অনুযায়ী সঠিক পরিচর্যাই হচ্ছে। তিনি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আমাদের এই কারাগারে দুটি শিশু বাচ্চা রয়েছে। একটির বয়স এক বছর। মনির বাচ্চার বয়স এক মাস। এ বয়সী শিশুর মায়েদের বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয়, কারাগার থেকে তাদের খাবার দেয়া হয়। তাছাড়া শিশুর পরিচর্যার জন্য আলাদা যত্ন নেওয়া হয়।
মায়ের সঙ্গে কারাবন্দী শিশুদের বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, মায়ের অপরাধে শিশুরা এভাবে কারাগারে বন্দিজীবন-যাপন করবে তা সুস্থ-সুন্দর সমাজ-পরিবেশের কাম্য হতে পারে না। একটা বাচ্চা কারাগারে জন্ম নিয়েছে এবং আগামী চার বছর কারাগারে থাকবেন বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে বাচ্চাটিকে কারাগারের বাইরে নিয়ে এসে লালন পালন করাও কষ্টসাধ্য। কেননা এই মুহূর্তে তার মায়ের সান্নিধ্যই তার প্রয়োজন। কষ্টের ব্যাপার এটা, মায়ের সাজা ভোগ করছেন অবুঝ শিশুটি।
এ মানবাধিকার কর্মী বলেন, বহির্বিশ্বে এসব ঘটনায় মায়েদেরকে উন্মুক্ত কারাগারে রাখা হয়। যেখানে ওই মা শিশুটিকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত যেতে পারবেন, নির্দিষ্ট মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবেন। সেই নিয়ম যেহেতু আমাদের কারাবিধিতে এখনো যোগ হয়নি। তাই আপাতত শিশুটি মায়ের কাছে থাকাটাই নিরাপদ।
শিশু হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মমিনুল হক বলেন, একটা শিশুর মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় শূন্য থেকে ৫ বছর। এই সময়টাতে সে যা দেখবে, যে পরিবেশ পাবে সেখানে থেকেই তার মানসিক বিকাশ ঘটবে। যদি কোন শিশু এই সময় কারাগারে থাকে। অবশ্যই সে পারিবারিক বন্ধন, সামাজিকতা থেকে দূরে থাকবে। তার বিকাশ অন্য সাধারণ শিশুর মতো হবে না। কিছুটা বুদ্ধি ও আচরণ প্রতিবন্ধকতা নিয়েই তাকে সারা জীবন চলতে হবে।