স্কাইফ'র তৈরি টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেটে মাদকাসক্তি প্রসঙ্গে

বিবিধ, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 23:31:44

যে কোনও ভোগ্যপণ্য সামগ্রী ব্যবসার জন্য বাজারজাত করলেই হয়না, জনগণের মধ্যে এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করতে হয়। বিশেষ করে, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়।

কোনো পণ্য বা ঔষধের বিপরীত ক্রিয়া করতে পারে বা অপপ্রয়োগ হতেই পারে। জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থে তা পর্যবেক্ষণ করা সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য। বাজারে পণ্য সরবরাহ করে শুধু লাভ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য খাদ্য ও ঔষধ কোম্পানিকে সরকার লাইসেন্স দেয়না। পণ্য ও ঔষধের ফলে যাতে জনগণের কোনো ক্ষতি না হয়, সেটাও নিশ্চিত করে।

কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি হয় বলে মনে হয় না। নানা ভেজাল ও মানহীন পণ্যের কারণে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এবার জানা গেলো একটি ঔষধের মারাত্মক অপব্যবহারের খবর।

খবরটি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন ফার্মেসিতে অবৈধভাবে চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে টাপেন্টা-১০০ ঔষধটি। কারণ হঠাৎ করেই মাদক সেবনকারীরা ইয়াবার পরিবর্তে টাপেন্টা নামক ব্যথানাশক ট্যাবলেটটি নেশার জন্য ব্যবহার শুরু করেছে। শহরের বিভিন্ন ফার্মেসির মালিকরা এই সুযোগে চড়া দামে বিক্রি করছে এ ট্যাবলেট।

আরও পড়ুন: ব্যথানাশক টাপেন্টা পরিণত হয়েছে মাদকদ্রব্যে

বার্তাটোয়েন্টিফোর'র প্রতিনিধি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন যে, 'ব্যথানাশক এই ট্যাবলেটটির কার্যকারিতা ইয়াবার সাথে মিল থাকার কারণে ইয়াবা সেবনকারীরা এর প্রতি আসক্ত হচ্ছে।'

চিকিৎসকের এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার যোগ্য। কেন ইয়াবার মতো একটি মারাত্মক নেশার মতো ফলাফল একটি ঔষধে পাওয়া যাবে? এটা তো হওয়ার কথা নয়। উৎপাদনকারী কোম্পানিকে অবশ্যই তাদের পণ্যের ব্যাপারে উত্থাপিত বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠ জবাব দিতে হবে।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম'র অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে যে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল রোডের চিহ্নিত কয়েকটি ফার্মেসি, জেলার মুন্সীগঞ্জ ও মোমিনপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি ফার্মেসি ইয়াবা সেবনকারীদের নিকট চড়া মূল্যে এসব ট্যাবলেট বিক্রি করছেন।

ঔষধের এহেন অপব্যবহার কেবল চুয়াডাঙ্গায় সীমাবদ্ধ, তার গ্যারান্টি নেই। দেশের অন্যত্রও এমনটি ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তো জানা উচিত যে, তাদের ঔষধের কেমন প্রতিক্রিয়া ও অপপ্রয়োগ হতে পারে? তাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় উৎপাদিত ঔষধের মান, গুণ, প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ বিষয়ক গবেষণা থাকার কথা। মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে যে ব্যবসা, তাতে শুধু ব্যবসা করে লাভ হাতালেই চলেনা, সমাজে ও মানুষের মধ্যে ঔষধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভালমন্দও নিয়মিতভাবে নিরীক্ষা করতে হয়।

স্কাইফ বাংলাদেশ লিমিটেডে কাজটি করেনি। তাদের তৈরি ঔষধ টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেটের যে চরম অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে, তার ব্যাপারে কোম্পানির কোনো বক্তব্য না আসা বা পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় এটাই প্রমাণ হয়, কোম্পানিটি জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্যবসা ও লাভ করাই তাদের একমাত্র কাজ, যা একটি ঔষধ কোম্পানির মান ও নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

অথচ বার্তাটোয়েন্টিফোর-এ প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যাচ্ছে, চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিস বিষয়টি জানে। সে অফিসের সূত্রেই প্রকাশ পেয়েছে যে, দেশের নামকরা ওষুধ কোম্পানি স্কাইফ বাংলাদেশ লিমিটেডের তৈরি টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেট প্রতিটি ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ২০ টাকা মূল্যের ব্যথানাশক এ ট্যাবলেট সেবনে রোগীর অতিরিক্ত ব্যথা কমাতে কাজ করে। এছাড়া অনেক রোগী অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করলেও চিকিৎসক এই ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ এতে রোগীর দুশ্চিন্তা ও নার্ভাসভাব কমে যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঔষধ কোম্পানি, অসাধু চিকিৎসক ও ঔষধ ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধা দিয়ে এমন একটি বিপজ্জনক ঔষধের বিক্রি বাড়াচ্ছে এবং অপপ্রয়োগের পথ দেখাচ্ছে। যার ফলে ২০ টাকার একটি ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা মূল্যে। এই লাভের বখরা ভাগ হচ্ছে কোম্পানি, অসাধু চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। আর হাজার হাজার তরুণ-যুবক আক্রান্ত হচ্ছে নতুন ধরনের এই মরণ নেশায়।

স্কাইফ বাংলাদেশ লিমিটেডের তৈরি টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেট সম্পর্কে চরম অপব্যবহার ও মাদক হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর পরই কোম্পানির উচিত ছিল ঔষধটি প্রত্যাহার করা। এ ঔষধকে মাদক হিসাবে অপব্যবহার রোধ করার জন্য এর প্রস্তুতপ্রণালী খতিয়ে দেখার জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়ারও দরকার ছিল।

কিন্তু এর কোনটিই করা হয় নি। ফলে বিশেষ এই ঔষধের মাদক হিসাবে অপব্যবহার ভয়াবহ রূপ লাভ করার আগেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও উৎপাদনকারী কোম্পানির পক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ঔষধের মতো জীবন-মরণ নিয়ে ব্যবসাকারী প্রতিষ্ঠানকে কেবল ব্যবসা করে লাভ হাতালেই চলবে না, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থের বিষয়গুলোকেও যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং চুয়াডাঙ্গার জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে এই ঔষধের মাধ্যমে অসাধুচক্র মাদকাসক্তির সমস্যাকে আরো বাড়াতে না পারে। মনে রাখা দরকার, ফেনসিডিল এক সময় নিরাপদ ঔষধ ছিল এবং তা কফ-কাশির জন্য ব্যবহৃত হতো। পরে সেটি মাদক হিসাবে জনপ্রিয়তা ও ব্যাপক প্রসার লাভ করে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হলে তার উৎপাদন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়।

ব্যথানাশক স্কাইফ বাংলাদেশ লিমিটেডের তৈরি টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেটটিরও ফেনসিডিলের মতো নেশাদ্রব্যে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটি নতুন মাদক হিসাবে ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে এর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে হবে। মাদকাসক্তি সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে নতুন কোনো নেশাদ্রব্য ও মাদকের উদ্ভব প্রতিরোধ করার জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। স্কাইফ'র তৈরি টাপেন্টা-১০০ ট্যাবলেটে নেশাসক্তি প্রসঙ্গে আশু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর