ঢাকা: পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগে প্রথম বিদেশি প্রকৌশলীরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল, ‘হোয়ার ইজ দ্যা রিভার? দিস ইজ সি!’(কোথায় নদী, এটাতো সাগর).. । এই বিস্ময় ছাপিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় শুরু হয়েছিলো স্বপ্নের সেতু নির্মাণ যজ্ঞ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় কোন নির্মাণ কাঠামো। প্রতিকূলতা ছিলো পানি, মাটি, বায়ু সব দিক থেকেই। তারপর আধুনিক প্রযুক্তি কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে সেতু গড়ার অনবদ্য কৃতিত্বের দিকে এগিয়ে চলে বাংলাদেশ। গেল ৯ মাসে ৬ টি পিলারের ৫ টি স্প্যান বসানো হলো। দেখা যাচ্ছে পৌনে এক কিলোমিটার সেতু কাঠামো।
তবে শুধু ৬ টি খুঁটি আর ৫ টি স্প্যান নয় আরও অনেক অগ্রগতি হয়েছে সেতুর কাজের। নদী তলদেশে ও উপরে সুপারস্ট্রাকচার কাজের এসব অগ্রগতির নানা তথ্য বার্তা২৪.কম কে জানিয়েছেন পদ্মাসেতু প্রকল্পের প্রকৌশলীরা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ‘পুরো প্রকল্পের ৫৩ ভাগ কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে। চলছে বাকি কাজ।’
কাজ শুরু হয়েছিলো তিন বছর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো নির্মাণের সব খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার নিজে।
পিলার বা পিয়ার কাজ
নদীতে মূল সেতুর ২৭২ টি পাইলের মধ্যে ১৫০ টি পাইল ড্রাইভ হয়েছে। নদীর দুই পাড়ে সেতুতে উঠার ট্রানজিশন পিলারের ৩২ টি পাইলের সবগুলো ড্রাইভ সম্পন্ন।
পদ্মা সেতুর প্রকল্প সূত্র জানায়, নদীতে ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নম্বর পিলারের কাজ শেষ হওয়ার পর ৫টি স্প্যান বসানো হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ৩, ৪ এবং ৫ খুঁটি পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু ৩ টি পিলারের ওপর যে স্প্যান বসানো হবে তা এখনও চীনে রয়ে গেছে। এছাড়া কাজ চলমান রয়েছে, সেতুর ১, ২, ৯, ১২, ১৩, ১৪, ১৬, ১৭ নম্বর পিলারে।
এখন স্প্যান মাওয়া পাড়ে আছে মডিউল ৬-এর। মডিউল ৬ এর পিলারগুলো হলো ৩১ থেকে ৩৬। নদীর তলদেশের জটিলতার কারণে এসব পিলারের কাজ তুলনামূলক পিছিয়ে পড়েছে। এছাড়া মডিউল-৫ এর ৬ টি পিলারে বসানো জন্য ২ টি স্প্যান প্রস্তুত আছে মাওয়ায়। এসব পিলারের কাজও পিছিয়ে আছে একই কারণে। এছাড়া ৬ এবং ৭ নাম্বার পিলারে ওপর যে স্প্যান বসবে সেটিও প্রস্তুত আছে মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়াডের ভেতরে।
সেতু প্রকল্পের একজন প্রকৌশলী জানান, কাজ আটকে নেই। কিছু পিলারের কাজ পিছিয়ে আছে বলে স্প্যান এই মুহতে বসানোর মতো নেই। তবে ৩ মাস পর একের পর এক স্প্যান উঠতে থাকবে। আর এখন ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ এবং ৩৭ নম্বর পিলার গড়ে তোলার কাজ চলছে।
স্প্যান বা ট্রাস (সুপারস্ট্রাকচার)
সুপারস্ট্রাকচার কাজ পুরোটাই হয় মাওয়া পাড়ে কন্সট্রাকশন ইয়াড ও চীনে। ৪১ টি স্প্যানের ৫টি বসিয়ে দেওয়ার পর এখনও স্প্যান বসানো বাকি ৩৬ টি স্প্যান। কয়েকটি স্প্যান মাসদুয়েকের মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশের পথে রওয়ানা দেবে।
১৫০ মিটার লম্বা একেকটি স্প্যানের ওজন ৩২০০ টন। মাওয়া থেকে নদীর মধ্যে এসব স্প্যান নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিশেষ ‘লিফটিং ফ্লোটিং ক্রেন’ ব্যবহৃত হয়। এটিও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তির ক্রেন। এর ক্ষমতা ৩৬০০ টন।
হ্যামার (হাতুড়ি) যা দিয়ে পদ্মায় পাইল ড্রাইভ হয়
পদ্মায় রয়েছে ৪ টি হ্যামার। একটি ২৪০০ টন, একটি ১৯০০ টন, একটি ১০০০ টন- এগুলো এখন সক্রিয় রয়েছে। বিকল আছে ৩০০০ কিলোজুলের একটি হ্যামার। এছাড়া গত বছরের শেষদিকে ৩৬০০ টনের জামানি থেকে আনা হ্যামারটিও অনবরত কাজ করছে।
সময় ও টাকার হিসেব
এখন পর্যন্ত এ সেতুর সাড়ে ৫৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছিলো তিন বছর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু অবস্থদৃষ্টে কাজ চলতি ডিসেম্বরে শেষ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নদী তলদেশের মাটির গঠনগত বৈচিত্রের কারণে অন্তত ৬ মাস কাজ পিছিয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে- বার বার সড়ক ও সেতুমন্ত্রী দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি শেষ হতে দেরির বিষয়টি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ শেষ হবে তা নিদিষ্ট করে বলা যাবে আরও ৩ মাস পর।
দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নিমাণে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, নদী শাসন কাজে ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, মাওয়া সংযোগ সড়ক নিমাণে ১শ কোটি ৯৩ লাখ টাকা(১৯৩.০০) জাজিরা সংযোগ সড়ক নিমাণে ১ হাজার ৯৭ (১,০৯৭.০০) কোটি টাকা। দুটি সাভিস এরিয়া নিমাণে (২০৮.০০) টাকা। পুনর্বাসন, জমি অধিগ্রহণ, অস্থায়ী নদী সুরক্ষা কাজে ব্যয় ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।