পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যখন আকাশ ছুঁয়েছে তখন বিশ্ব বাজারের খোঁজ নিতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, একটা কথা বলা হয় সিন্ডিকেট। আমি ১০ বছর মন্ত্রী ছিলাম। আসলে সিন্ডিকেট বলে কোন কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
রোববার (০১ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্য সচিব উপস্থিত ছিলেন।
অস্থির সবজি বাজার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, সবজির দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে কিভাবে? ধরেন, যশোর থেকে একটা কপি কেনা হলো ১০ টাকা দিয়ে, যশোর থেকে কিনে রাস্তা দিয়ে আসে ট্রাকে করে। রাস্তায় কোন কোন জায়গায় ট্রাক থামায়, পয়সা নেয়, আনতে একটা খরচ হয়। খরচ হওয়ার পর ক্রেতাদের হাতে যায়।
বৈঠকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, আজকেও ব্যবসায়ীরা আমাকে বললেন—আমরা ভোজ্য তেল এনে লাভ করি ৫০ পয়সা, তাদের কাছ থেকে যারা নেন তারা লাভ করে ১ টাকা। মাঝখানে তার থেকে নেয় ফড়িয়ারা। এখন ফড়িয়ারা যদি এক টাকার জায়গায় ১০ টাকা লাভ করে, এটা তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না এবং এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। যদি নিয়ন্ত্রণ করতে যান তারা বলবে ইমপোর্ট করব না।
আরও পড়ুন: পেঁয়াজের দাম কবে কমবে বলা মুশকিল: বাণিজ্যমন্ত্রী
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আজকের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে একটা সভা করব। যেখানে দেশের বড় বড় আমদানিকারকদের ডাকা হবে, খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধি, বাংলাদেশের ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে নিরূপণ করব আমাদের কোন জিনিসের চাহিদা কত, উৎপাদন কত হচ্ছে। প্রত্যেকটা পণ্যের বাৎসরিক চাহিদা কত, কী পরিমাণ দেশে উৎপাদন হয় এবং কী পরিমাণ আমদানি করতে হয়। আগেই যদি সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে পদক্ষেপ নেই তাহলে আকস্মিকভাবে যে ঘটনাটি ঘটে গেল সেটা ঘটার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, এবারের ঘটনাটা ব্যতিক্রম। আমরা চাহিদার ৬০ ভাগ পেঁয়াজ উৎপাদন করি। আর ৪০ ভাগ আমাদের আমদানি করতে হয়। এই ৪০ ভাগের আবার ৯০ ভাগই আসে ভারত থেকে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তারা রপ্তানি বন্ধ করে দিল। কারণ, উত্তর ভারতের লোকরা পরটার সাথে পেঁয়াজ খায়। তাদের উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি। তারাও আমদানি করেছে। আমদানির পেঁয়াজ আবার রপ্তানিও করেছে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা এখন সচেতন, ভুল থেকে অনেক সময় শিক্ষা নিতে হয়। ভারত থেকে আনলে ৫-৬ দিন লাগে আর মিশর থেকে আনতে প্রায় ২ মাস লাগে। তুরস্ক থেকে আনতে দেড় থেকে ২ মাস সময় লাগে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করব। এই পেঁয়াজ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হবে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশে এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দামটা একটু বেশি। মিয়ানমারে যেটা কম ছিল, সেটাও বেড়ে গেছে। ভারতে ১২০ রুপি। এটা সাময়িক সমস্যা, পেঁয়াজের মূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এসে যাবে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে যদি দাম বাড়ে তাহলে বেড়ে যায়। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাজারদর ক্রয় ক্ষমতার আওতায় আনতে সক্ষম হব। আজকে পেঁয়াজের যে সংকট এই সংকট থাকবে না।
উদাহরণ দিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা এক সময় কোরবানির গরুর জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু ভারত যখন কড়াকড়ি করল সেটা আমাদের সাপে বর হলো। ভারত গরু রপ্তানি করল না, আমাদের দেশের মানুষ গরু পালতে শুরু করল। আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে পেঁয়াজ নিয়ে যে ঘটনা ঘটল, আমরা মনে করি সাধারণ মানুষ যার বাড়ি আছে তার একটা দরজা আছে, তার দরজায় খোঁলা জায়গা আছে, সেই জায়গা খোলা রাখবে না, সেই জায়গায় পেঁয়াজ চাষ করবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে পেঁয়াজ রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হব। আমরা রপ্তানি করব। একটা আকস্মিক ঘটনা ঘটে। কিছু দিনের মধ্যেই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর সমর্থনে সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের সভাপতি হিসেবে আমারও রেসপন্সিবিলিটি আছে। মন্ত্রী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেছেন না। প্রধানমন্ত্রী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, আশা করি ভারতও কিছুদিনের মধ্যে রপ্তানি যেটা বন্ধ করেছে, সেটা থাকবে না। আমাদেরও এই সিজনের পেঁয়াজ চলে আসবে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে সাবেক মন্ত্রী বলেন, একটা কথা বলা হয় সিন্ডিকেট। আমি ১০ বছর মন্ত্রী ছিলাম। আসলে সিন্ডিকেট বলে কোন কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এটা একটা তথ্য সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীরা আমাদের বন্ধু। আজকে মিটিংয়েও বলেছি ধরপাকড় জোরজবরদস্তি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সবাইকে আপন করে সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে সমস্যার সমাধান করব।
আগে থেকে কেন চাহিদা ও উৎপাদনের হার নিরূপণ করা হয়নি— এমন প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, করা যে হয় না, তা না। এটা আকস্মিকভাবে হয়েছে। প্রয়োজনমতো নিরূপণ করা যায় নাই। হঠাৎ করে ঘটনাটা ঘটেছে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করল, ভারত যদি বন্ধ না করতো এটা হতো? তবে অনেক সময় ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি বলেন, আজকেও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বড় আমদানিকারক। তারা যে দামে আনে সেই দামেই, এক পয়সা লাভ না করে, কোনো লাভ না করে টিসিবিকে দিয়েছে। কিন্তু এটার তো ভ্যাট আছে, উড়োজাহাজে আনলে দাম পড়ে ২৫০ টাকা। আর জাহাজে আনলে সাড়ে ৩৭ টাকা। টিসিবি কোন লাভ করে না। ব্যবসায়ীরা এত উপকার করছে, তারাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে—আমরা লাভ করব না, যে পরিমাণ খরচ হয় সেই পরিমাণে সরকারকে দেব। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে পৃথিবীর সব দেশে কখনও কখনও এরকম হয়।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কত পরিমাণ বাড়ছে খোঁজ নেন। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এখানে মিল আছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক ভাবে তো আমরা এখন মজবুত। গ্রামে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা খুব কম। জিনিসপত্রের দাম সবসময় ওঠা-নামা করে। তবে আপনারা সাহায্য করেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।