ঢাকা ছিল সংস্কৃতিবান মুঘলদের তৈরি বাগিচা নগরী। দখলদার হলেও পরবর্তী শাসক ইংরেজরা ঢাকাকে উদ্যান ও বাগিচায় ভরে দিয়েছিলেন। সবুজের সমারোহের পাশে বহমান বুড়িগঙ্গা নদী তীরের সজীব ও বিশুদ্ধ বাতাসের সেই প্রাণবন্ত ঢাকা এখন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে।
ধুলিমাখা, মলিন ঢাকার দিকে তাকানো যায় না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে উড়ন্ত ধুলাবালি, ধোয়া, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাসায়নিক, যান্ত্রিক আবর্জনা-কণিকার আঘাতে। শ্বাসরুদ্ধ হয় দূষিত বাতাসে। ঢাকার বাতাস থেকে অক্সিজেন বিতাড়িত করে বায়ুমণ্ডল দখল করেছে ক্ষতিকর উপাদান।
ইউরোপ এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দেশের (কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড) তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ ৩০ থেকে ৪০% ভাগ কম অক্সিজেন প্রবহমান বাতাসে পেয়ে থাকেন। ফলে উপমহাদেশের মানুষের শ্বাসযন্ত্রের ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। গবেষকগণ মাঠে-ময়দানে সরেজমিন ক্ষেত্র সমীক্ষা করে জানিয়েছেন, কম অক্সিজেন প্রাপ্তি, ধূমপান ও অন্যান্য ব্যক্তিগত অনিয়ম ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে উপমহাদেশের মানুষের লাংস বা শ্বাসতন্ত্র আধুনিক, উন্নত ও পরিবেশ-ভারসাম্যপূর্ণ এলাকার মানুষের চেয়ে ২৫-৩৫% ভাগ দুর্বল বা অক্ষম।
এসব তথ্য পাওয়া গেছে কল্পনা বালাকৃষ্ণ সম্পাদিত বায়ু দূষণ বিষয়ক গবেষণায় এবং এতে দিল্লি, ঢাকা ইত্যাদি শহরের তুলনামূলক তথ্য রয়েছে। এবং পরিতাপের বিষয় হলো, বায়ু দূষণে ঢাকা শহর দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বিশ্বের কুখ্যাত-দূষিত শহরের শীর্ষস্থানে এসে গেছে। এ শীর্ষস্থান প্রাপ্তি শুধু অসম্মানেরই নয়, ভয়ঙ্কর বিপদ ও আতঙ্কের কারণ। [দ্রষ্টব্য: Balakrishnan, Kalpana edited “The Impact of Air Pollution on Death, Disease Burden, and Life Expectancy across the States of South Asia: The Global Burden of Disease Study 2017,” Lancet
Planetary Health, Vol 3, No 1, pp 26–39.]
পরিস্থিতি কতটুকু ভয়াবহ হয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ দিচ্ছে আরেকটি গবেষণা। এতে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ঢাকাসহ বায়ু ও অন্যবিধ দূষণাক্রান্ত শহরের অধিবাসীদের শ্বাস নেওয়ার বা পাফ নেওয়া ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তার মানে হলো, দূষিত বাতাস ও বিপজ্জনক উপাদান বুকের শ্বাসযন্ত্রে টানতে টানতে লাংস-এর বারোটা বেজে গেছে। বুক ভরে আর শ্বাস নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না নিয়মিত দূষিত টক্সিনে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায়।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শ্বাস গ্রহণের ক্ষমতা চীনাদের। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি শহরের মানুষ চীনাদের চেয়ে ২১.২% ভাগ কম পাফ নিতে বা শ্বাস গ্রহণ জরতে পারে। অঙ্গহানির মতো অঙ্গের কার্যকারিতা কতদ্রুত কমছে, তা ক্রমবর্ধমান লিভার, কিডনি, হার্ট ও লাংস রোগের বিস্তার থেকে অনুমেয়। [দ্রষ্টব্য: K. Banyan, “The Blowhard Index: South Asians Have 21.2% Less Puff Than the Chinese,” Economist, 28 January, 2019]
দক্ষিণ এশিয়ার বিপজ্জনকভাবে দূষিত শহরের শীর্ষে ছিল দিল্লি। কিন্তু ঢাকার যে বহুমুখী অধঃপতনের তথ্যচিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে দূষিত শহরের শীর্ষের স্থানটি দখল করেছে ঢাকা। বার্তা২৪.কম'র ভিডিও রিপোর্টিং ঢাকার সর্বসাম্প্রতিক দূষণের দিকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। এতে ঢাকার অবনতিশীল পরিবেশ পরিস্থিতি ও দূষণ বিস্তারের প্রাথমিক তথ্য রয়েছে, যা গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
এককালে রমনার মোহনীয় সবুজের রমণীয় সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর ঢাকা শহর চোখের সামনে বিপজ্জনকভাবে দূষিত হয়ে মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত অসংখ্য সমস্যা। ঢাকা হয়ে যাচ্ছে বসবাসের অনুপযুক্ত। এই ভয়ঙ্কর নাগরিক বিপদ ও সামাজিক বিপর্যয়ের কবল থেকে বাঁচার উপায় অতিসত্বর বের করতে হবে। রক্ষা করতে হবে ঢাকা শহরকে। বাঁচাতে হবে ঢাকাবাসীদের।