অপরাধ নির্মূলে বন্দুকযুদ্ধ কতটা কার্যকর?

, জাতীয়

শাহরিয়ার হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 14:41:33

ঢাকা: মাদকবিরোধী অভিযান চলছে দুই মাস ধরে। এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে প্রায় ১৫০ জন। গত ১৫ বছরে র‍্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ১৮৫। দীর্ঘ সময়ের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধের পরিসংখ্যান টেনে এমন তথ্য দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো 'ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধকে' 'বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড' হিসেবে উল্লেখ করে এর তীব্র সমালোচনা করছেন। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন অপরাধ নির্মূলে বন্দুকযুদ্ধের কার্যকারিতা নিয়েও।

আসকের (আইন ও সালিশ কেন্দ্র) সাবেক ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার করে চলমান বিচারহীনতা সংস্কৃতিকে বেগবান করছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীগুলো নিয়মিতভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। যদি এ ভাবে চলতে থাকে সমাজ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। বন্দুকযুদ্ধ এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। অপরাধ নির্মূলের সঙ্গে মানুষ হত্যার কোন সম্পর্ক নেই।

র‍্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই কঠোর অবস্থানেই থাকতে হবে, এই জায়গায় দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ নেই। আর মাদকের সঙ্গে অস্ত্রের সম্পর্ক আছে। আছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অনেক অপরাধেরও সম্পর্ক। বিশ্বে জুড়ে মাদককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বড় বড় গ্যাং কাজ করছে। সেক্ষেত্রে মাদকবিরোধী অভিযানে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের অনেকে বলছেন, 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'ক্রসফায়ার' এ ধরণের ব্যবস্থায় সাময়িকভাবে লাভ হচ্ছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অপরাধ দমনে স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলবে না।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক সুব্রত ব্যানার্জি বার্তা ২৪.কমকে বলেন, বন্দুকযুদ্ধ করে অপরাধ নির্মূল করতে গেলে সমাজের একটা অংশ সমর্থন করবে। অন্য অংশ নেতিবাচক ভাবেই বিষয়টা দেখবে বলে আমার ধারণা।

এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বন্দুকযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২০০৫ সালে ৩৫৪ জন, ২০১৬ সালে ১৫৯ জন, চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৩৯ জন।

২০০৪ সালে সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। ২০০৫ সাল শেষ হতে না হতেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫৪ জনে। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁতে জঙ্গি হামলার পর, জঙ্গি নির্মূল করতে টানা অভিযানে এক বছরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১৫৯ জন। চলমান মাদক বিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। অপরাধ নির্মূলে বন্দুকযুদ্ধ সমাধান হতে পারে না।

বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, যে কোন অভিযান আইনি ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। মাদক বা সন্ত্রাসের সাথে যেমন অস্ত্রের সম্পর্ক আছে, তেমনি আছে টাকার সম্পর্ক। এই সব অভিযান গুলোতে তারাও (সন্ত্রাসী) তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে পাল্টা আক্রমণ করে। যার ফলে গোলাগুলির মত ঘটনা ঘটে, উভয় পক্ষই আহত নিহত হয়।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে যারা মারা যাচ্ছেন, তারা কি ভাল মানুষ ? এক একজনের বিরুদ্ধে ৫/১০ টা করে মামলা রয়েছে। তাছাড়া পুলিশ বা র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনার পর একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেটি তদন্ত করে দেখেন। ঐ প্রতিবেদনে বিস্তারিত দেওয়া থাকে। এখানে লুকিয়ে রাখার কিছু নেই।

এদিকে সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা তরুণ সমাজকে ধ্বংসের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কঠোর অবস্থানকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

অপরাধ নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানও মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধে সাময়িক ভাবে সফলতা দেখা দিলেও, পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা আবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠে। যে কোন অপরাধ দমনে সব সময় সামাজিক আন্দোলন কার্যকারী ভূমিকা রাখে। মাদকের ক্ষেত্রেও সামাজিক আন্দোলনের  উপর জোর দেওয়া উচিত।

তবে বাদ প্রতিবাদ যাই হোক-থেমে নেই মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। র‍্যাব পুলিশ নিজেরাই ঘটনা গুলোকে 'বন্দুকযুদ্ধ' বলছেন। বুধবার (১০ জুলাই) বন্দুকযুদ্ধে দেশের চার জেলায় পাঁচজন নিহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিহতদের শীর্ষ মাদক বিক্রেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর