আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) যে সিদ্ধান্তই দিক না কেন, মিয়ানমার তা মেনে চলবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সজাগ থাকতে হবে যেন কোনো অজুহাতে মিয়ানমার এটি এড়িয়ে যেতে না পারে।
জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি বৃহস্পতিবার ( ২৩ জানুয়ারি) হোটেল লা মেরেডিয়ানে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেষবারের মতো বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সফর করছেন তিনি। ১৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ সফর ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চলছে।
ইয়াংহি লি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য এর আগেও বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলাম। এবারও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছি।
তবে এবারও আমাকে মিয়ানমার তাদের দেশ সফরের অনুমতি দেয়নি। এ জন্য আমি হতাশা প্রকাশ করছি। কিন্তু মিয়ানমার যতই অপছন্দ করুক না কেন আমি সত্য প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করব না। আমি যে রিপোর্ট জমা দেব, তাতে অবশ্যই
পক্ষপাতিত্ব হবে না।
মিয়ানমার আমাকে তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি। জাতিসংঘের একজন বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারকে তাদের দেশে এ ইস্যুতে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় মিয়ানমারেরই ক্ষতি হয়েছে। কারণ এতে তাদের মনোভাব সম্পর্কে বিশ্ব জেনেছে, যোগ করেন তিনি।
ভাষানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সম্পর্কে ইয়াংহি লি বলেন, এ সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না। মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। রাশিয়া ও চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে যেভাবে সমর্থন করছে, তা লজ্জাজনক। বিশেষ করে চীন বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে চায়। কিন্তু তারা কীভাবে মানবিকতা এড়িয়ে চলে?
তিনি বলেন, ক্যাম্পে আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক নারীই আমাকে বলেছেন যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্বিচারে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে। খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারাও বলেছেন যে তারাও একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
উদ্বাস্তুরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। এক রোহিঙ্গা বাবা আমাকে বলেছেন, আমার কথা চিন্তা করতে হবে না। আমার বাচ্চার শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিন। আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারকে তাদের প্রতি উদারতা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সামনের সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে বলে আশা করি। কিছু এলাকায় নিরাপত্তার অজুহাতে ভোট সীমাবদ্ধ করা হতে পারে। মিয়ানমারের ২০২০ সালের নির্বাচন সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করি।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলায় জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেল ৩টায় সিদ্ধান্ত জানাবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। এ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ ঐতিহাসিক দিন। আমি আশা করি, এ সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী নৃশংস নির্যাতন চালায়। নৃশংসতা থেকে বাঁচতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মিয়ানমার এই জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
এর সূত্র ধরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করে। এবং এর বিচার চেয়ে গত ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) ‘গণহত্যা’র মামলা করে।
মামলার ৪৫ পৃষ্ঠার আবেদনে গাম্বিয়া উল্লেখ করে, মিয়ানমার গণহত্যা, ধর্ষণ এবং সম্প্রদায় ধ্বংসের মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে’ ‘গণহত্যা’ চালায়।
এ মামলায় প্রথম ধাপে ১০ ডিসেম্বর শুনানি করে গাম্বিয়া। ১১ ডিসেম্বর শুনানি করে মিয়ানমার। ১২ ডিসেম্বর উভয়পক্ষ একসঙ্গে শুনানিতে অংশ নেয়।
শুনানির তৃতীয় দিনে গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বলেন ওআইসির সিদ্ধান্তে গাম্বিয়া মামলা করেছে—কথাটি ঠিক নয়। এর আগে মিয়ানমার পক্ষের আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টকার দাবি করেন, ওআইসির মদদে গাম্বিয়া গণহত্যার মামলা করেছে।
এসময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি বলেন, আরাকানে কোনো গণহত্যা ঘটেনি, সেখানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই করছে সে দেশের সেনাবাহিনী।
তবে এ মামলার পক্ষে কথা বলছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিশেষ করে দেশটির বিদ্রোহী কারেন জনগোষ্ঠী গাম্বিয়ার এ মামলাকে স্বাগত জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা তদন্তের নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)৷ তবে মিয়ানমার বলছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের এ উদ্যোগ কোনোভাবেই আইনসঙ্গত নয়৷ কারণ মিয়ানমার এখনও আইসিসি সনদে স্বাক্ষর করেনি, তাই দেশটি এ ট্রাইব্যুনালের সদস্যও নয়৷ কিন্তু আইসিসি বলছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ সংস্থাটির সদস্য হওয়ায় এ তদন্তের এখতিয়ার তাদের রয়েছে৷