প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা আইন-২০১৯’ এ শিক্ষা-সহায়ক অনুশীলনমূলক বইকে ‘নোট-গাইড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধের যে কথা এসেছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। অনুশীলন বই বন্ধ হয়ে যেতে পারে- এমন সম্ভাবনায় বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
ক্লাসে পাঠদানের ঘাটতি, শিক্ষক স্বল্পতা, সন্তানদের সহায়তা করায় অনেক অভিভাবকের সীমাবদ্ধতা- এসব কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে অনুশীলনমূলক বই। বইগুলোর প্রকাশকরাও বলছেন, একতরফাভাবে এসব বই বন্ধের উদ্যোগ নিলে তা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক অসুবিধার সৃষ্টি করা ছাড়াও সার্বিক প্রকাশনা শিল্পের বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তারা বলছেন, অনুশীলনমূলক বই সংক্রান্ত কার্যক্রমে ১০টি শিল্পের ৪ লাখ ৬২ হাজার পরিবার যুক্ত। এটি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ সব মিলিয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকাকে হুমকির মধ্যে ফেলবে।
শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, নানা কারণেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে অনুশীলনমূলক বইগুলো। দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এসব বই পড়ছে। বিভিন্ন কারণে অনেকক্ষেত্রেই এখন শ্রেণিতে যথাযথভাবে পাঠদান হয় না। ক্লাসের বার্ষিক কর্মঘণ্টা কম। এর পাশাপাশি সব শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারার কারণে শিক্ষাখাতে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনেই দেখা গেছে, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালুর এক দশক পরও দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকই এখনো সঠিকভাবে এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না। তারা বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন বা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দেশে বর্তমানে মোটাদাগে দুই ধরনের সমস্যা রয়েছে। শহরের নামকরা শিক্ষায়তনে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এক একটি শ্রেণিকক্ষে ৮০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকে। একজন শিক্ষকের পক্ষে এত বেশি শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে, যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি আছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে অনুশীলন বই। এ সহায়ক বই-ই প্রথাগতভাবে নোট-গাইড হিসেবে পরিচিত।
অভিভাবকদের কেউ কেউ তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রচার মাধ্যম থেকে অনুশীলনমূলক বই বন্ধে আইন হতে পারে বিষয়টি সম্প্রতি জেনেছেন রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছোট চাকরি করি। তিন সন্তানের জন্য যথেষ্ট গৃহশিক্ষক রাখার সামর্থ্য আমার নেই। নিজেরাও পড়ানোর মতো তেমন সময় করতে পারি না। সেক্ষেত্রে এই বইগুলো অনেকটা গৃহশিক্ষকের কাজ করত। অনুশীলনমূলক বই না থাকলে আমাদের মতো পরিবারগুলো খুব সমস্যায় পড়বে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধানমন্ডি এলাকার একজন অভিভাবক বলেন, ‘শিক্ষকরাই যেখানে সৃজনশীলের প্রশ্ন করতে হিমশিম খান সেখানে আমরা কীভাবে সন্তানকে পড়াব?’ অভিজ্ঞ শিক্ষকরা মনে করেন, অনুশীলনমূলক বই বন্ধ করা হলে শিক্ষার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ সবার পক্ষে এক বা একাধিক গৃহশিক্ষক রাখা সম্ভব নয়। অনেক বাবা-মা নিজেদের ব্যস্ততা বা শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতার কারণেও সন্তানদের পড়াতে সক্ষম নন। নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা অসংখ্য। আর গ্রাম পর্যায়ে এ অবস্থা আরও শোচনীয়। সুতরাং অনুশীলন বই নিষিদ্ধের বিষয়টি অগুণতি শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণকে বিপন্ন করে তুলবে।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়া গত সপ্তাহে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য শিগগিরই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। ‘নোট-গাইড’ বন্ধের প্রস্তাবের পাশাপাশি এ আইনে শিক্ষকদের সবধরনের কোচিং-টিউশন নিষিদ্ধ এবং শর্তসাপেক্ষে বাণিজ্যিক কোচিংকে বৈধতাদান করা হয়েছে।
এদিকে অনুশীলন বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এলে তা সার্বিক প্রকাশনা শিল্পের জন্যই মহাসংকট সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কবিতা, গল্প ও উপন্যাসসহ সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবাই অনুশীলনমূলক গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত। দেশের সৃজনশীল প্রকাশনার বাজার খুবই সীমিত উল্লেখ করে একজন প্রকাশক বলেন, অনুশীলনমূলক বই বন্ধ হলে অনেক সৃজনশীল গ্রন্থের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়বে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, এসব গ্রন্থ প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে অন্তত ৮টি পেশার ২৩ লাখ ১০ হাজার মানুষ জড়িত। এই খাতে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। এসব গ্রন্থের প্রকাশনা বন্ধ করা হলে সরকার একদিকে শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে, আরেকদিকে অসংখ্য কর্মহীন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে।
সরকার নোট-গাইডের বিকল্প খুঁজছে বলে জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নোট গাইড কেন চলে তা আমরা জানতে চাই। সেটা চিহ্নিত করার পরে আমরা পরবর্তী অ্যাকশনে যেতে পারি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, নোট-গাইডের বিকল্প আমরা চাই।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে রাজধানী মতিঝিলের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষক মো. ফজলুল হক বলেন, অনুশীলনমূলক বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ পরিস্থিতির পেছনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত কারণ আছে। সেসব সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। সুতরাং শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুচিন্তিত, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ‘গাইড-নোট’ মার্কা সেটে দিয়ে অনুশীলন বই বন্ধ করে দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের হাত থেকে শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়ার সামিল।’