১.
মাসব্যাপী বইমেলা বাংলাদেশের এক গর্বের ঘটনা। ফেব্রুয়ারি মাস পুরো দেশই বইমেলাময় হয়ে ওঠে। চিলমারী, উলিপুর, সুন্দরগঞ্জ, দেবীগঞ্জ থেকে সারাদেশেই বইমেলা আর বইমেলা। স্থানীয় তরুণরা বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বই এনে বিক্রি করেন মেলাগুলোতে। অধিকাংশই বই বিক্রি না হওয়ার হতাশায় পড়েন। স্থানীয় বইমেলাগুলোকে কেন্দ্র করে জন্ম নিচ্ছে স্থানীয় লেখক সমাজ।
ফেসবুক ভেঙে দিয়েছে শহর-গ্রামের দেয়াল। ফেসবুক জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন লেখকের। আগে পত্রিকার সম্পাদকের পছন্দ-অপছন্দ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লেখককে ঢাকার বাসিন্দা হওয়া জরুরি ছিল। সেসব পুরনো দিনের ঘটনা। বইমেলা আর ফেসবুক মিলে মফস্বলেও জন্ম নিচ্ছে নতুন লেখকের নতুন পাঠক শ্রেণি। এ এক অভিনব লেখক-পাঠক সমাজ।
২.
গ্রাম সমাজে মেলা মাত্রই স্বতন্ত্র। পীর-ফকির, আউল-বাউল, ভাসান, স্নান, বোলান, কথকতা নিয়ে মেলা বসে। কিন্তু ইহজাগতিক মেলাও আমরা দেখেছি। পহেলা বৈশাখ যেমন। বঙ্গভঙ্গের ফল হিসেবে পেয়েছি স্বদেশী মেলা। তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ফল একুশে বইমেলা। স্থানিক দূরত্ব ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা মেলাগুলোকে স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে। একেকটা মেলা একেক কারণে বিখ্যাত। কৃষ্ণনগরের বারদোল মেলা যেমন মৃৎশিল্পের জন্য, চিলমারীর অষ্টমীর মেলা তেমনি দই ও মাছের জন্য। কিন্তু দেশ জুড়ে অনুষ্ঠিত বইমেলা সেই নিজস্ব চেহারা এখনও অর্জন করতে পারেনি।
ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনীর বই স্থানীয় সংগঠকরা কিনে এনে বিক্রি করেন। রংপুর, সিলেট ও রাজশাহীর মত বড় শহরে স্থানীয় লেখকদের ভরসায় কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কোনোটি আবার রংপুরের 'ডাকঘর' এর মত অনুবাদ ও ক্লাসিক বই প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু নিজ অঞ্চলের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি নির্ভর প্রকাশনা দিল্লি দূর অস্ত এখনও। মানে রাজবংশী, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাওসহ অন্যান্য জাতির ভাষা ভিত্তিক প্রকাশনা নাই। বইমেলাগুলো স্থায়ী রূপ পেলে ধীরে ধীরে তা বিকশিত হবে।
নব্বইয়ের দশকেও মফস্বলগুলোতে ছোটকাগজের গ্রুপ ছিল। নিসর্গ, ক্যাথারসিস, ছাপাখানা, একবিংশ, লিরিক এর মতো ছোটকাগজগুলো মর্যাদা নিয়ে ছিল। পত্রিকার নামেই বই বেরুত। আজ আড্ডাগুলোও গেছে। সম্পাদকরাও বদলে গেছেন।পত্রিকাগুলোর সংখ্যা বেরোয়, কিন্তু সাড়া জাগায় না।
৩.
বলা হয়, রাশানরা সেরা বই পড়ুয়া জাতি। তাদের ৭৪ ভাগ পরিবারে পারিবারিক পাঠাগার আছে। তারা তীব্র শীতেও ট্রেনে-বাসে দাঁড়িয়ে বই পড়ে। ইউরোপের পশ্চাৎপদ একটা দেশ এমনি এমনি এই রকম হল? রাশিয়ায় লেনিনরা বিপ্লব করেন ৭ নভেম্বর। আর রাশিয়া জুড়ে 'সুইস-আমেরিকান' পদ্ধতিতে পাঠাগার গড়ে তুলতে লুনাচারস্কির সাথে কথা বলেন ৯ নভেম্বর। মানে বিপ্লবের তৃতীয় দিনে। তারপর ১৯১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি 'কাউন্সিল অব পিপলস কমিশনার' থেকে বিষয়টা পাশ করিয়ে নেন। একই সালে শুধু গ্রন্থাগার বিষয়েই সভা করেছেন ১৬টি। তারা বলতেন, গ্রন্থাগার সকলের জন্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বইয়ের জন্য মজার মজার কর্মসূচি নেয়। কোনও দেশ ট্রেনে বই নিয়ে দেখালেই আর টিকেট লাগে না।
আমাদের বাজেট ৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। আমাদের একুশে বইমেলায় এ বছর বিক্রি ৮২ কোটি টাকা। এটা প্রকাশকরা বলছেন। কিন্তু লেখকরা বলছেন কমছে কম ২০০ কোটি টাকার।
প্রতিটি উপজেলায় এখনও সরকারি গ্রন্থাগার গড়ে ওঠেনি। পাঠাগারগুলো শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। চাকরিজীবীরা কাজ শেষে পাঠাগারগুলোতে আসার পথ বন্ধ। প্রতিবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাখ টাকার মেরামত হয়, কিন্তু ৫ হাজার টাকার বইও কেনা হয় না। সরকারি অফিসগুলোতে গেলে জাঁকজমকে চমকে যেতে হয়। কিন্তু বইয়ের একটা র্যাকও পাবেন না। সব কিছুই আছে, শুধু বই নেই।
অথচ একটি উপজেলায় গড়ে ২০০টি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। মৎস, সমবায়, সমাজ সেবার মত অফিস আছে কুড়িটির মত। এনজিও আছে ২০/২৫টি। এরকম আড়াইশটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ৫হাজার টাকার বই কিনলে একটি উপজেলাতেই বই লাগে সাড়ে ১২ লাখ টাকার। আর ১০ হাজার হলে হয় ২৫ লক্ষ টাকার। প্রতি বছর উপজেলা পর্যায়ে ২৫ লক্ষ টাকার বই কেনা হলে শুধু উপজেলা পর্যায়েই ১২৫ কোটি টাকা। এছাড়া হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো তো হিসাবের বাইরেই রয়েছে। ইদানিং বাসে-ট্রেনে বইয়ের তাক করার দাবি উঠেছে। তার প্রভাব সমাজে কী সুদূর প্রসারী হবে, কল্পনা করা যায়? শুধু সরকার থেকে নির্দেশনামা দরকার। কিন্তু শুনেছি, বইমেলার জন্যও নাকি সরকারের কোনও বাজেট নেই। কত টাকা কত দিকে যায়, শুধু বইয়ের বেলায় নাই নাই!
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।