মৃত্যুপ্রহরে ঢাকার খাল, অনেকগুলোই এখন স্মৃতি

ঢাকা, জাতীয়

আকরাম হোসেন, স্টাফ করসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 08:39:53

রাজধানী ঢাকা থেকে একে একে উধাও হয়ে যাচ্ছে একসময়ের প্রাণবন্ত খালগুলো। রাজধানীজুড়ে প্রবহমান খালগুলোর করুণ মৃতুর গল্প এখন পুরনো মানুষের মুখে মুখে। ঢাকার যোগাযোগ ক্ষেত্রে যে খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত তার সিংহভাগ এখন দখলদারদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে। আর যেগুলোও আছে দখল ও দূষণে তা পরিণত হয়েছে নোংরা নালায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় জলাবদ্ধতার নেপথ্যে খাল দখল। খাল, জলাধার ও নিম্নাঞ্চল দখল ও ভরাটের কারণে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য চারপাশের নদী ও খালগুলোকে দখলমুক্ত করে নাব্যতা ও পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

দখল ও দূষণে খাল পরিণত হয়েছে নোংরা নালায়

জানা যায়, ঢাকা শহরে ৫০টিরও অধিক খাল জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, এসব খাল গিয়ে মিশেছে নদীতে। বৃষ্টি হলে শহরের পানি গিয়ে পড়তো খালে, খাল দিয়ে পানি চলে যেত নদীতে। পানির সঙ্গে সঙ্গে ময়লা আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যেত।

এসব খালের অধিকাংশ এখন দখল আর ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু কিছু এলাকায় দিনের পর দিন জমে থাকছে পানি। সরু ড্রেনের মতো বয়ে চলা এসব খাল একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, আবার এর ভেতরে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও কম ঘটছে না। দূষণ খাল থেকে আশপাশে রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। মশা-মাছির প্রকোপ বাড়াচ্ছে এসব খাল।

খালের অধিকাংশ এখন দখল আর ভরাট হয়ে গেছে

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে ৫০টি খাল রয়েছে।

জেলা প্রশাসকের দেয়া তথ্যের সঙ্গে মিল নেই ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশে ট্রাস্ট (ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট) গবেষণার। তারা বলছে স্বাধীনতার পূর্বে রাজধানী ঢাকাতে ৪৭টি খাল থাকলেও বর্তমানে ২৬টি খাল রয়েছে। বাকি খালগুলো সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে।

দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি খাল

প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ঢাকা শহরের খাল নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা পর থেকে অনেকগুলো খালের কথা খাতা-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই।

রায়েরবাজার খাল: কাঁটাসুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে সরাই জাফরাবাদ ও সুলতানগঞ্জ মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়েরবাজারের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রায়েরবাজার খাল ছিল। পুরো খালই ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

পরীবাগ খাল: শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল ছিল। তবে সেখানে এখন খালের কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না। খাল ভরাট করে সোনারগাঁও সড়ক বানানো হয়েছে।

খালের বেহাল দশা

গোপীবাগ খাল: গোপীবাগ থেকে শুরু হয়ে ওয়ারী, ব্রাহ্মণচিরণ, আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

পান্থপথ খাল: পান্থপথের পিচঢালা সড়কের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি বিশাল খাল ও জলাভূমি। যেখানে ধানমন্ডি খাল দিয়ে এই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে পান্থপথ হয়ে বেগুনবাড়ি খালে পড়ত। পান্থপথ খালের উপর বর্তমানে সড়ক ও বড় বড় অট্টালিকা বানানো হয়েছে।

এছাড়াও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের গবেষণা থেকে জানা যায়, আরামবাগ, সেগুনবাগিচা, গোবিন্দপুর, কাঁঠাল বাগান, নারিন্দা খালের কোনো অস্তিত্বই এখন নেই।

খাল বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে

রাজধানীতে যেসব খালের অস্তিত্ব আছে সেগুলো বিলুপ্তের পথে। খালে আবর্জনা ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে গেছে। হাজারীবাগ খাল, মান্ডা খাল, জিরানি খাল, ধোলাই খাল, কদমতলা খাল ঘুরে দেখা য়ায় খালের উপর নানা অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তার মধ্যে আছে বহুতল ভবন, আধপাকা ঘর, কাঁচাঘর, টংঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সীমানা দেয়াল, দোকান, ওয়ার্কশপ, রাস্তা, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, পলিথিন কারখানা, রিকশার গ্যারেজ, বেকারি ইত্যাদি। খালগুলোর উপরে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, রাজধানীর খাল দখলমুক্ত রাখতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকি। খালের বেদখলে বিষয়টা আমাদের নজরে আসলেই আমরা উচ্ছেদ করি। বেদখলের বিষয়টা সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার সঙ্গে আমরা দেখি। তবে ময়লা, আবর্জনা ও দূষণের বিষয়টা সিটি করপোরেশন দেখাশোনা করে। এখনো অনেক খালের সঙ্গে নদীর সংযোগ আছে। তবে অনেকেই বলে থাকেন আগে অনেক খাল ছিল, অনেক খালের সঙ্গে নদীর সংযোগ ছিল। কিন্তু নিদিষ্ট করে জানতে চাইলে বলতে পারে না।

ঢাকায় জলাবদ্ধতার নেপথ্যে খাল দখল

যে খালগুলোর অস্তিত্ব আছে তার রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা থেকে খালের বিলুপ্ত, দখন ও দূষণের জন্য আইনের প্রয়োগ ও সরকারের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে মনে করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বার্তা২৪.কে জানান, খাল দখল মুক্ত করার জন্য নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়। তবে খাল দখল মুক্ত করতে গেলে নানা বাঁধা আসে। খালের জায়গাতে অবৈধ স্থাপনা থাকে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে গেলে তারা মামলা করে। সেগুলো নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কোর্টে মামলা চলতে থাকে।

রাজধানীর খালের অবস্থা কি আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব; এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে খালেরই জীবন-মরণ অবস্থা। সেখানে নদীর সঙ্গে খালের সংযোগ অনেক দূরের ব্যাপার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, খাল দখলের বিষয়টা শুধু ঢাকা শহরে নয়। সারা দেশের নদী-নালা, খাল, ঝিল, বিল সবকিছু দখলের কবলে। যারা দখলের সঙ্গে জড়িত তারা অনেক প্রভাবশালী। সরকারের ভিতরে ও বাইরে, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।

প্রবহমান খালগুলোর করুণ মৃতুর গল্প এখন পুরনো মানুষের মুখে মুখে

তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগের অভাবে এসব খাল দখল ও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকার খাল উদ্ধারের কথা বললেও আন্তরিকতা অভাব রয়েছে। সরকার চাইলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সরকারের চেয়ে কোনো কিছু শক্তিশালী হতে পারে না। আইনের প্রয়োগ ও সরকার আন্তরিক হলে খাল উদ্ধার সম্ভব।

নদী ও পানি বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর মহাসচিব শেখ রোকন বার্তা২৪.কমকে বলেন, খাল দখল উচ্ছেদ সম্ভব হচ্ছে না মূলত রাজনৈতিক কারণে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সে দলের স্থানীয় রাজনীতিবিদরা খাল দখল করে নানা স্থাপনা তৈরি করে। শহরের উন্নয়ন মডেলে আমাদের ভুল আছে। খালকে খালের মত থাকতে দিতে হবে। উন্নয়নের নামে সুইজ গেট, বক্স কালভার্ট দেয়া বন্ধ করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা গড়ে উঠেছে। ব্যাপারটা এমন না যে ঢাকাকে কেন্দ্র করে নদী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য নদীকে নদীর মত থাকতে দিতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর