ইতালিকে বলা হচ্ছে 'ইউরোপের চীন'। করোনাভাইরাসের আক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ইউরোপ মহাদেশে সর্বপ্রথম ঘটেছে ইতালিতে। সেখানে রোগের চেয়ে রোগটি সম্পর্কে আতঙ্ক ও জনমনে মহামারীর ভয়ের কারণে ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশি।
ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্গিও মেটারেলা করোনাভাইরাসের 'রিয়েল ফেয়ার' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন 'জনমনে সৃষ্ট মহামারীর ভয়'কে। দেশটির মনস্তাত্ত্বিক এসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট 'ভীতি, চাপ ও উদ্বেগ' কমাতে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করছে।
ফিওনা ক্যামেরন লিস্টার নামে একজন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মী তার ব্লগে ইতালির 'রিয়েল ডেনঞ্জার অব করোনাভাইরাস' শিরোনামে জানাচ্ছেন, রোগের বিপদ তো আছেই এবং তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু জনমনে যে ভীতি ও উৎকণ্ঠা, তা থামানো জরুরি। কারণ, করোনা মহামারী হতে পারে, এই ভীতিই করোনার আসল বিপদ বা 'রিয়েল ডেনঞ্জার'।
ইতালিতে করোনা মোকাবেলায় কাজ করছেন, এমন একাধিক সূত্র আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে যে, রোগের বিস্তার সামলানোর পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসা ও শুশ্রূষা দিয়ে সারিয়ে তোলা হচ্ছে। মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনা গেছে।
কিন্তু বিপদ হয়েছে অন্যত্র। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চেতনায় আঘাত করে মনোবল ভেঙে দিয়েছে করোনাভাইরাস। এতে বিরাট ক্ষতির হয়েছে। মানুষ ব্যক্তিগত বা সামাজিকভাবে রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারছেনা। উল্টা আতঙ্কগ্রস্ত ও আক্রান্ত হচ্ছে।
ইতালির অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সঠিক তথ্যের বদলে গুজব প্রচারিত হয়েছে বেশি। নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও অসমর্থিত তথ্যের কারণে মানুষ করোনাভাইরাস মোকাবেলার সাহস হারাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
করোনা নিয়ে এই গণআতঙ্কের ফল হয়েছে মারাত্মক। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিপণি বিতান কোনও ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে পড়েছে। সামনের মাসে বসন্ত উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন 'ভেনিস ক্যার্নিভ্যাল'-এর স্টল ভাড়া, প্যাভিলিয়ন নেওয়া ও টিকেট বিক্রির হার এতোটাই তলানিতে ঠেকেছে যে, উদ্যোক্তারা প্রথমবারের মতো এই অভিজাত উৎসবের আয়োজন বাতিল ঘোষণা করেছেন। একজন বিষণ্ণ ও হতাশ মানুষের মুখচ্ছবি সম্বলিত পোস্টার প্রকাশ করে শুরুর আগেই ক্যার্নিভ্যালের পর্দা টানা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে নানা রোগের বিস্তার ও মহামারী নতুন কিছু নয়। কোনও কোনও রোগ এপিডেমিক বা মহামারী হয়ে পেনডেমিক বা বিশ্ব-মহামারীতেও পরিণত হয়েছিল। প্লেগ, বসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ অতীতে বিশ্বব্যাপী মহামারীর আকার ধারণ করেছিল।
কিন্তু অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ফারাক হলো, তখন জনস্বাস্থ্য ও সতর্কতার বিষয়গুলো এতো প্রখর ছিলনা। চিকিৎসাবিজ্ঞানও ছিল পিছিয়ে। ফলে মহামারীতে লোকক্ষয় হয়েছে অনেক বেশি।
তবে, সে পরিস্থিতির যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। এখন উন্নত স্বাস্থ্যবিধি, ঔষধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা এবং সামাজিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। এই সক্ষমতার কারণে অতীতের মতো অবাধে রোগ ছড়াচ্ছে না এবং অকাতরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে না। হলেও সেটাকে ঠেকানো যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মনোবল ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি যদি ভেঙে পড়ে, তবেই আসল বিপদ নেমে আসে। রোগের চেয়ে রোগের আতঙ্ক ক্ষতি করে বেশি। এমন ভীতি ও শঙ্কা মহামারী আকারে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে, এমনই অভিমত স্বাস্থ্য রোগ বিশেষজ্ঞদের।
ইতালির অভিজ্ঞতায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাস নিয়ে যে কোনও আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন বিশ্বের সকল দেশের অধিবাসীদের। গুজব বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত বা সামাজিক উৎকণ্ঠা যাতে মোটেও বাড়তে না পারে, সে বিষয়েও হুশিয়ার করেছেন তারা। তাদের মতে, সতর্ক ও সচেতন থেকে প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধ পালন করে চলাই এ পরিস্থিতিতে বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি সবার মধ্যে রোগটিকে প্রতিরোধের জন্য দৃঢ় মনোবল ও কমিটমেন্ট বজায় রাখা দরকার। তাহলেই রোগটি মহামারীর আকার ধারণ করে বিপজ্জনক পর্যায়ে যেতে পারবেনা।
রোগের সঙ্গে মানুষের শরীর ও মনের নিবিড় সম্পর্কের নিরিখে দেখা গেছে, দুর্বল শরীর ও ভীত মনের মানুষ দ্রুত আক্রান্ত হয়। তাদের রোগমুক্তির হারও কম এবং উপশম গতিও শ্লথ। ফলে ভীতি বা আতঙ্কিত হয়ে নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানগত দিকের পাশাপাশি সামাজিক সাহস ও ব্যক্তিগত-মনস্তাত্ত্বিক মনোবল দিয়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে একযোগে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।