ঢাকা: সড়ক দুর্ঘটনায় বাস মালিকদের দায় কতটুকু- এখন এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকে মনে করছেন এমন দুর্ঘটনায় মালিকের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস দেওয়ার কোনো বিধান বিদ্যমান আইনে নেই। তবে ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি মালিকের ওপর বর্তাতে পারে।
গত ৩ আগস্ট মগবাজার ওয়ারলেসে ফ্লাইওভার থেকে নামছিল ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে চলাচলকারী এসপি গোল্ডেন লাইনের একটি কাউন্টার সার্ভিস বাস। তখনই একটি মোটরসাইকেল সামনে চাপা পড়ে। এতে মৃত্যু হয় মোটরসাইকেল চালকের। পরে ওইদিন রাতেই সাতক্ষীরায় বাড়ি ঘেরাও করে এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনের মালিক মো. জোনায়েদ লস্করকে র্যাব ধরে নিয়ে যায়। পরে পুলিশ একদিন রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু এই বাস দুর্ঘটনায় কতটা দোষী ছিলেন ওই বাস মালিক? বা এরকম দুর্ঘটনায় মালিকদের আসলে কী দোষ? বার্তা২৪-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস মালিকদের নির্দেশ অমান্য করে চালক টার্মিনাল থেকে গোপনে বাস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। তবে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক ছিল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার পর বাস মালিককে বাড়ি ঘেরাও করে আটক করার ঘটনা নজিরবিহীন। দুর্ঘটনার পর থানায় দু’জন কাউন্টার ম্যানেজার গেলে তাদেরও আটক রেখে জেলহাজাতে পাঠানো হয়। এটা এমন সময় ঘটেছে যখন দেশজুড়ে চলছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলছিল আর সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ দুর্ঘটনায় বাস মালিককে আটক করে রিমান্ডে নেওয়া এবং সেখান থেকে কারাগারে পাঠানো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আইনের চোখে এমন দুর্ঘটনায় মালিকের ওপর ক্রিমিনাল কেস করা যায় না। বড়জোর সিভিল লাইএবলিটি বা আর্থিক ক্ষতিপূরণে দায় দেওয়া যেতে পারে। এখানে পাবলিককে শান্ত করার জন্য চাপে পড়ে মালিকের ওপর ক্রিমিনাল লাইএবলিটি আনা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মালিকের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস দেওয়ার ঘটনা ব্যাতিক্রম।’
ওই আইনজীবী বলেন, ‘এ ঘটনা নিয়ে আমি নিজেও কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। তারা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মালিককে আটক করার মতো কোনো ঘটনা সেদিন ঘটেনি। এখানে তার কোনো ক্রিমিনাল লাইএবলিটি নেই। এখানে পাবলিক পারসেপশন বিবেচনায় নিয়ে মালিকের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল লাইএবলিটিতে আসামি করা হয়েছে। বর্তমান আইন বা প্রচলিত আইনের কোথাও মালিককে আটক করার বিধান নেই। এটা আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে। তবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গ আসলে মালিক দায়ী হতে পারেন। তবে দুর্ঘটনার দায় মালিকের ওপর বর্তাবে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট মগবাজার ওয়ারলেসে যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল সেটি এসপি গোল্ডেন লাইনের কাউন্টার টু কাউন্টার সার্ভিসের জন্য ব্যবহৃত হতো। বাসটির রেজিস্ট্রেশন টেক্স-টোকেনসহ সবই ছিল হালনাগাদ। মিনি বাস হিসেবে সারাদেশেই চলাচলের অনুমোদন ছিল। তবে মালিক মিনি বাসটি তার দূরপাল্লার বাসের যাত্রীদের এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। কখনও কখনও বাসের স্টাফরা তাদের কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্যও বাসটি ব্যবহার করতেন। এটি সিটি সার্ভিসে চলাচলের জন্য ছিল না। সব কোম্পানির বাস এদিন অঘোষিত কর্মবিরতিতে ছিল। বাসের মালিক নিজেও জানতেন না তার একটি মিনি বাস রাস্তায় বেরিয়েছে। বাস প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার-মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্যারেজ থেকে চালক একধরনের চুরি করে বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তখন নগরীতে গণপরিবহনের সংকট থাকায় টাকা উপার্জনের আসায় চালক ইমরান একজন হেলপার নিয়ে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।
বাসের রেজিস্ট্রেশনের কাগজ ঘেঁটে দেখা গেছে, বাসটি ছয় মাস আগে রাস্তায় নামানো হয়। ৩০ সিটের বাসটির সিটসহ ভেতরের ডেকোরেশন ছিল একদম নতুন। বাসটি মতিঝিল কল্যাণপুর গাবতলীর রুটে কাউন্টার সার্ভিসের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু নগরীর যাত্রীদের পরিবহন হিসেবে এটি রাস্তায় চলার কথা ছিল না।
এই সড়ক দুর্ঘটনার পর একটি মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানা পুলিশের এসআই মিজানুর রহমান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, ‘বাসটি মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে নামছিল। আর মোটরসাইকেলটি কমিউনিটি হাসপাতালের গলি থেকে থেকে বের হয়ে মূল সড়কে উঠছিল। এমন অবস্থায় বাসের সামনে পড়ে যায় মোটরসাইকেলটি। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। বাসটি ততক্ষণে ব্রেক ধরে সামলে উঠতে পারেনি। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেল চালক নিহত হন।’
এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার জাহাঙ্গীর বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘যেদিন বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে সেদিন নগরীর রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা, যানবহনও কম ছিল। দিনে দূরপাল্লায় সব বাসের চলাচল মালিকরাই বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু টাকা আয়ের জন্য চালক বাসটি নিয়ে শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন। তবে চালক ইমরানের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিক ছিল।’
জানা গেছে, এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহন কোম্পানির ও মালিক লস্কর গ্রুপের চেয়ারম্যান জোনায়েদ লস্কর বাইয়ুন। প্রত্যক্ষভাবে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে সক্রিয় নন। পরিবহন ব্যবসা ছাড়াও তার অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে। সাতক্ষীয়ায় বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের ডিলারশিপ নিয়েছেন তিনি। ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে তার মোট ৩০টি গাড়ি চলে।