বৃহস্পতিবার এলো, বাবা এলো না…
মা কাঁদছেন। কেঁদে চলেছেন দাদাভাই-দাদুমণিও। ফুফি-নানুর চোখেও জলের ধারা। ছোট্ট মাশরুরা জাহান তাসকিয়া কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না-যারা প্রতিদিন তার কান্না ভোলায়, আজ তারাই কেন এত করে কাঁদছে! আরও বুঝে উঠতে পারছে না কেন ঘরভর্তি এত এত মানুষ! সারা দিনই পাড়া-পড়শি আর চেনা-আদচেনা মানুষের আনাগোণা। কিন্তু এত এত মানুষের ভিড়ে কিনা তার প্রিয় বাবাটাই নেই। পরিচিত কাউকে পেলে তাই শিশুটি অব্যক্ত কণ্ঠে বলে ওঠছে, ‘আমার বাবা কই?’ উত্তর দিতে না পেরে স্বজনেরা মুখ লুকান, ফের ডুবে যান কান্নায়!
তিন বছরের তাসকিয়া এখনো জানে না, তার বাবা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ আর ফিরবেন না। মঙ্গলবারের (২৬ নভেম্বর) মন খারাপের বিকেল যে বাবা-মেয়ের মাঝে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদের দেয়াল গড়ে দিয়েছে। ওইদিন চট্টগ্রাম নগরীর আদালত চত্বর এলাকায় তাসকিয়ার বাবাকে নির্মমভাবে খুন করেছেন সন্ত্রাসীরা।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত হওয়া আলিফ ছিলেন সাত ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। পেশার তাগিদে তিনি থাকতেন বন্দরনগরীতে। মেয়ে আর স্ত্রী থাকতেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদরের দরবেশহাটের টেন্ডল পাড়ার বাড়িতে, বাবা-মায়ের সঙ্গে। সারা সপ্তাহের কর্মব্যস্ততা শেষে বৃহস্পতিবার বিকেলেই আলিফ ছুঁটতেন মেয়ের কাছে। দুদিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আবার ফিরতেন শহরে।
বাড়িতে ফেরার আগে স্ত্রীর ফোনে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে নিতেন আলিফ, বলতেন ‘কি লাগবে মা’! সপ্তাহ ঘুরে সেই বৃহস্পতিবার ফিরে এলো আজ! ওই স্মৃতি তুলে ধরে আলিফের ভাগ্নি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী জান্নাতুল মাওয়া তাকি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজ বৃহস্পতিবার! প্রতি বৃহস্পতিবারে মামা বাড়িতে আসার আগে মেয়ের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করতেন তার কি লাগবে। সে বলতো, বাবা আমার জন্য লাল কাপড় আনিয়েন।’ বাবার সেই ফোন আর কখনো আসবে না তাসকিয়ার কাছে। তাসকিয়ার নিথর-নিস্তব্দ বাবা যে কফিনে শুয়ে বৃহস্পতিবারের আগেরদিনই চলে এসেছেন বাড়িতে, চিরদিনের জন্য!
তাসকিয়া তাও বাবার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছে তার অনাগত ভাই/বোন তো বাবা কি জিনিস তাও হয়তো জানবে না! কেননা আলিফের স্ত্রী ইশরাত জাহান যে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এমন দুর্দিনে স্বামীকে হারিয়ে কথা বলার সব শক্তিই হারিয়েছেন এই গৃহবধূ, বারবার হারাচ্ছেন জ্ঞান।
দিনভর আলিফের কবর জেয়ারতে মানুষের ঢেউ লেগে আছে। একরাশ ক্লান্তি আর মন খারাপের এই সময়েও সেই মানুষদের সময় দিতে হচ্ছে আলিফের প্রবীণ বাবা জামাল উদ্দিনকে। সবাই চলে গেলে, ছেলের শোকে কেঁদে ওঠেন ছেলে হারা বাবা। তবে এমন শোকের মূহূর্তেও এই বেদনাহত বাবা দেশের মানুষকে দিয়েছেন শান্ত থাকার বার্তা। বলেছেন, ‘আমার ছেলের খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না হয় সেদিকে সবাই সতর্ক থাকবেন। বিনা অপরাধে যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিন।’
মা হোসনে আরার বেগমের কন্ঠজুড়ে শুধুই দীর্ঘশ্বাস। ছেলের মৃত্যুর পর দুই চোখের পাতা এক করতে পারেননি শোকাস্তব্দ এই মা। যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকে শুধু করে চলেছেন একটাই প্রশ্ন-‘কি অপরাধ করলো আমার ছেলেটা। এভাবে নৃশংসভাবে মেরে ফেলতে হলো।’
পাঁচ ভাই ও দুই বোনের ভরা সংসার হলেও সাইফুলই ছিলেন পরিবারের সবার কাছে প্রিয়। বড় বোন জান্নাত আরা বেগমের স্মৃতিতে ফিরে এলো ভাইয়ের কত-শত স্মৃতি, ‘আমার ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। তাহাজ্জুদও বাদ দিতো না। কারও কোনোদিন ক্ষতি করেছে, তা কেউ বলতে পারবে না। আমার এমন ছিল নম্র-ভদ্র, সোজাসাপ্টা ভাইকে কেন আমাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য ওরা কেড়ে নিলো? কোনোমতে বেঁচে রাখরেও তো ভাই বলে ডাকতে পারতাম, মেয়েটাও বাবা বলে ডাকতে পারতো।’
আলিফের শাশুড়ি সাজেদা বেগম স্বামী-হারা মেয়ে আর বাবা হারা নাতনিকে আগলে রেখেছেন। তারই ফাঁকে বললেন, ‘মঙ্গলবার সকালে আদালতে যাওয়ার সময় আমার মেয়েকে ফোন দিয়েছিল জামাই। বিকেলে আদালত থেকে ফেরার পর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে ফোনে কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু তার সেই ফোন আসেনি। আসে তারই মৃত্যুসংবাদ। আমার সন্তানসম্ভাবা মেয়ে, ছোট্ট নাতনির পৃথিবীটা খুব দ্রুতই ছোট হয়ে গেলো। জানি না সামনের দিনগুলো কীভাবে পার করবো!’
পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে শুরু করে। ঘরভর্তি মানুষও কমতে থাকে। প্রতিবেশীরা একে রওনা হন বাড়ির পথে। অন্ধকার নেমে আসা পৃথিবীতে, ছোট ছোট পায়ে বাড়ির সদরদরজার দিকে এগিয়ে যায় তাসকিয়া। খোলা দরজার ওপারে চোখ ফেলে একরত্তি মেয়েটা বলে ওঠে-‘বাবা, বাবা কোথায় তুমি? আসতেছো না যে?’
বাড়ির অদূরের কবরস্থানে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকা আলিফ মেয়ের সেই আকুল করা আদুরে ডাক শুনতে পান না! পাবেন না কোনোদিনও…