কলকাতা থেকে: ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট একটা মিটিং হওয়ার কথা ছিল। সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ও সক্রিয় নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট ভোরের সেই বিয়োগান্ত ঘটনায় সব ওলটপালট হয়ে গেল।
আমরা তখন চট্টগ্রামের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তোপখানা রোডে সম্রাট হোটেলে অবস্থান করছিলাম। হোটেলের নাইট গার্ড ভোর ৪টার দিকে আমাদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো- রাস্তায় সেনাবাহিনী ও ট্যাঙ্ক নেমে গেছে। তখন আমরা রাস্তায় গিয়ে দেখলাম ৪টি ট্যাঙ্ক, ৫টি সেনাবাহিনী ভর্তি জিপ প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে ও তাঁর ভাগ্নে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারবে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা কর হয়েছে। ধানমন্ডির নিজের বাসায় এ হত্যকান্ডের নেতৃত্ব দেয় সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল অফিসার।
এ খবর শোনার পর আমরা হতবাক ও হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। কি করবো বুঝতেও পারছিলাম না। হোটেলে ফিরে এলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে বের হলাম । প্রথম শাহবাগের পিজি হাসপাতালে। সকাল ১১টায় একটি ভ্যানে করে শেখ ফজলুল হক মনির ও তার স্ত্রীর লাশ আনা হয়। তিনি ছিলেন অন্তসত্ত্বা। ওইখান থেকে আমরা মিন্টু রোডে তোফায়েল আহমদ, কে এম ওবায়দুর রহমান (পরে বিএনপিতে যোগ দেন), ফনিভূষণ মজুমদারের বাসায় ঢোকার চেষ্টা করি। বাসা ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনীর টহল জিপ। আমরা দ্রুত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। একমাত্র তৎকালীন মন্ত্রী ফনিভুষণ মজুমদারের সাথে কিছুটা কথা হয়। তিনি নির্দেশ দিলেন চট্টগ্রাম ফিরে যাও। বিকেলে ট্রেনে করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা। পথে অনেক বাধা। একদিন পর এসে পৌঁছালাম চট্টগ্রাম।
১৮ আগস্ট মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল করি। আমাদের এ তৎপরতা দেখে পরদিন থেকেই পুলিশ ও সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর শুরু হয় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার। ৪৩ বছর পরও এসব স্মৃতি অম্লান। জাতির জনককে এভাবে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে- এটি ভাবলে এখনো মন কেঁদে উঠে।
তিনি শুধু একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেননি, তিনি বাংলাদেশকে বাঙালি জাতিকে বড় করে কিছু ভাবার ও স্বপ্ন দেখার পথও দেখিয়ে গেছেন। কতোটা দূরদর্শী হলে এরকম করে একজন নেতা ভাবতে পারেন। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন, আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। গরিব মেহনতি মানুষের কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর গড়া বাংলাদেশ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জন এখন। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মাতৃভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু আর মাথাপিছু আয় এখন অনেক উপরের দিকে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার আরো অপার সম্ভাবনা।
প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে। আমাদের চারপাশে আত্মীয় পরিজন সবই আছে। সুখে-দুখের জীবন চলছে স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু কেউ যেন এক আপনজন নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- হয়তো এতদিন বেঁচে থাকতেন কিংবা থাকতেন না। এটি বিতের্কর বিষয়। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ আমাদের অনুপ্রাণিত করছে প্রতি মুহূর্তে। তিনি একজন সাধারণ মানুষ হয়েও অসাধারণ সব ক্ষমতা ও গুণের অধিকারী ছিলেন। খেতে বসে নিজের পাতে তোলার আগে আশপাশের সবাইকে তুলে দিতেন আগে। খেতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি খাওয়াতেও পছন্দ করতেন। আপাদমস্তক একজন বাঙালি তিনি। সাদা ভাতের সঙ্গে শুটকি ভর্তা, ইলিশ ভাজা সঙ্গে পোড়ামরিচ খেতে ভালোবাসতেন। তিনি চট্টগ্রামে এলে থাকতেন হোটেল শাহজাহানে। প্রয়াত মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসা থেকে খাবার আসতো। তিনি পান্তা ভাত ও শুটকি ভর্তা খেতে পছন্দ করতেন। চায়ের সঙ্গে অবশ্যই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট খেতে ভালোবাসতেন। একবার জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসা থেকে দুপুরে ইলিশ ভাজা, শুটকি ভর্তা ও পান্তা ভাত নিয়ে আসা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু তখন জহুর আহমদ চৌধুরীকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘তুমি কি সকাল-বিকাল দুবেলাই পান্তা খাওয়াবে?’
অমলেন্দু সরকার : মুক্তিযোদ্ধা ও স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাসকারী
asarkar1952@gmail.com