সাহান আরা বেগমের চোখে ১৫ আগস্টের ভয়াল রাত  

জেলা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 05:44:27

বরিশাল: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সূর্যের আলো তখনও ফুটে ওঠেনি। এমনই এক সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠলো ঢাকার ২৭নং মিন্টো রোডের বাড়িটি। 

চোখের সামনেই হারিয়েছেন চার বছরের সন্তান সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতসহ পরিবারের ছয়জন সদস্যকে। ঘাতকদের গুলিতে তিনিসহ আহত হয়েছেন আরও অনেকে। তাইতো আগস্ট মাস আসলেই তার বুকের ভেতরে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই দিনের ভয়াল চিত্র। 

অশ্রু সজল নয়নে সেইদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি সাহান আরা বেগম।

ঘটনার বর্ণনায় প্রথমে শুরু করেন, ‘সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আজানের পর আমরা প্রচণ্ড গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও। 

আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কী কথা হয়েছে তা বলতে পারবো না। এরই মধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছিনা। 

মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। ওরা কী কোনো ড্রেস পড়ে আছে। আমি বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, তারপরেও দেখো, কারা আসছে। এরমধ্যে ফোনটি হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি শ্বশুরকে বললেন, কী ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলে না? 

শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি। ওনার সঙ্গে কী কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগোবে না, ভালো হবে না। ওরা (ঘাতকরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। বাসার কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। এ সময় একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন।’

এর মধ্যে ঘাতকরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে রুমে ঢুকে হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। তবে সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠবো। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহিদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর ভারি অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে উপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যে কারণে উপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি। 

তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদেরকে মারতে এসেছে, না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদেরকে বলল, তোমরা কী চাও? তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকেরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পরে যাই। 

শহিদ ভাইকে বন্দুক ঠেকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুর হয়ে পরে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। 

এর মধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌঁড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নয়জন কাতরাচ্ছিলাম। 

এরমধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে। 

এর মধ্যে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ উপর থেকে নিচে নেমে আসলেন। কিছুক্ষণ আগেও আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম, এখন অনেকেই লাশ হয়ে পড়ে আছে।  

হাসানাত এসে তার বাবার হাতের পালস দেখে ছেড়ে দিল। আর আমি বললাম সুকান্ত বাবুকে একটু দেখো। শহীদ ভাইকে একটা টান দিয়ে বাবুর শরীর থেকে সরিয়ে দিল হাসানাত। তখন শহীদ ভাইয়ের বুকের ভেতর থেকে শব্দ বের হল। তার নিঃশ্বাসটা বের হয়ে গেল। বাবুর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, আরিফ সেরনিয়াবাত পাশে পড়ে আছে। তখন তো জানতাম না আরিফের মাথার মগজ গুলি লেগে বের হয়ে গেছে। সবাই ওখানে আহত ও নিহত ।

পুলিশ জিপে করে আমাদের উঠিয়ে দিল। আর ওসি ভদ্রলোক বার বার বলল স্যার (হাসানাত) আপনি এখানে থাকবেন না। ওরা আবার এসে আপনাকে মেরে ফেলবে। 

তারপরে ওরা আমাদের মেডিকেলে নিয়ে গেল। মেডিকেলে আমাদের যখন নামাচ্ছিল, তখন আরেকটি জিপে করে মনি ভাই ও আরজু ভাবিকে নিয়ে এসে নামানো হচ্ছে। সবাই  জরুরি বিভাগে ভর্তি হল। ওখানে আমরা চারজন জীবিত ছিলাম। আমি, আমার শাশুরি, চার নাম্বার ননদ আর ছোট ননদ। 

আমাদেরকে ইমার্জেন্সি বেডে নিয়ে গেল। তখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় কাজ করে একটা ছেলে, নাম মনে নেই, সে আমার পাশ দিয়ে হাঁটছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তবে ও কিছু বলল না।  চুপ করে চলে গেল। পরে খুকির মা (শেখ কামালের শাশুরি) এসে আমাকে খুঁজে। তখন তার কাছে জানতে পারলাম আমাদের সবই শেষ। 

তারপর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আলাদা করে রাখলেন। কাউকে কথা বলতে দিলেন না। তাছাড়া আমি ছাড়া কথা বলার মতো অবস্থায় কেউ ছিলও না। আমার দুই ননদ এবং শাশুরি সবাই অজ্ঞান ছিল। একদিন কি দুইদিন আমাদের ওইখানে রাখল। কারণ তখন অনেক লোক আসতেছিল গোপনে দেখা করার জন্য। তখন ওরা বাধ্য হয়ে দরজায় পুলিশ পাহারা দিয়ে আমাদের আলাদা একটা রুমের মধ্যে রাখলো।

মেডিকেলে ডিরেক্টর ছিলেন একজন আর্মি অফিসার। এখানে কোনো কমতি ছিল না। আমাদের সবাইকে তিনি সহযোগিতা করেছেন। তবে একদিন পরেই আমার বাবা দেখতে গেল। আমাদের কারো শরীরে তেমন কাপড় ছিল না। দুইদিন আমার গায়ে ব্লাউজ ছিল এবং একটা চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। কারণ বুলেটে আমার পরনের পেটিকোট আর ব্লাউজ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে এবং রক্তে সব নষ্ট হয়ে গেছে। যার জন্য চাদর দিয়েই ঢেকে রাখা হল। তখন বাবা কিছু কাপড় কিনে এনে দেয়। আমার জীবিত থাকা ছেলে মেয়ে কান্তা ও সাদেককে নিয়ে বাবা বরিশাল চলে আসে। 

বরিশালে এসেও আমার বাবা শান্তিতে থাকতে পারে নাই। বরিশালের বাড়িতে প্রতিদিন পুলিশ ঘেরাও দিত। আমার বাবাকে জেলে নিয়ে গেল, ১৫ আগস্টের ঘটনায় তিনি আড়াই বছর জেল খেটেছে।’ 

সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় বরিশালের ছয়জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। 

তারা হলেন- সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনের জামাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতী সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। 

আহত হয়েছিলেন নয়জন। তারা হলেন- আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মিনী আমেনা বেগম, বেগম সাহান আরা বেগম, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ প্রমুখ।

সাহান আরা বেগম আরও বলেন, ৭৫’র ১৫ আগস্টের ঘটনায় আমি বাদী হয়ে মামলা দিয়েছিলাম। কারণ ১৫ আগস্টের সেই ট্রাজেডির ঘটনায় পরিবারের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তখন একজন আসামিও ধরা পড়েছিল। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার মামলাও চলতেছিল। যার ফলে ওই মামলাটি কিছুদিন স্থগিত ছিল। পরে আর রি-ওপেন করা হয়নি। তারপরে ঝড়-যুদ্ধ, ওয়ান ইলেভেন, ক্লিন হার্ট, বিভিন্ন কারণে সেটা আর হয়নি। তবে আমাদের ওই মামলার অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে বলেছি, ওই মামলাটা আবার চালু করার জন্য।’

প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার বোনজামাতা ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭নং মিন্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকরা। সেই বাড়িটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদরদপ্তর হিসেবে পরিচিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর