নেপালে লাশের অপেক্ষায় স্বজনেরা

, জাতীয়

সেন্ট্রাল ডেস্ক ৪ | 2023-08-25 15:57:03

নেপালে মহারাজগঞ্জ মেডিকেল ক্যাম্পাসের টিচিং হাসপাতালের মর্গের সামনে সকাল থেকে বসে আছেন বাসিমাহ সাইফুল্লাহ। ইউএস-বাংলার দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজের কেবিন ক্রু ছিলেন তাঁর ভাই খাজা হোসেন মোহাম্মদ শফি। দুর্ঘটনার তিন দিন পরও তিনি ভাইয়ের লাশটি দেখতে পাননি। আক্ষেপ করে বললেন, ‘লাশ কবে দেশে নিয়ে যাব, সেটা জানার আগে লাশটি তো দেখব। তারও অনুমতি পাচ্ছি না।’ এটুকু বলতেই গলা ধরে আসে তাঁর। শুধু বাসিমাহ নন, তাঁর মতো লাশের অপেক্ষায় বসে আছেন অন্য সব বাংলাদেশি, নেপালি, চীনের নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা। নিহত ৫১ জনের কারও লাশই মর্গে আনার পর স্বজনদের দেখতে দেওয়া হয়নি। ময়নাতদন্ত শেষ না হলে কোনো লাশ দেখতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন টিচিং হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রমোদ শ্রেষ্ঠা। টিচিং হাসপাতালের মর্গের সামনে এখন স্বজনদের ভিড়। কীভাবে লাশ নিয়ে যাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। এর আগে তাঁরা মৃতদেহ দেখতে চান। ইউএস-বাংলার কাঠমান্ডু অফিসে কাজ করতেন হরি শঙ্কর পাওয়াল। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তিনি নিহত হন। তাঁর ভাই হরিচরণ পাওয়াল মর্গের সামনে বসে আছেন প্ল্যাকার্ড হাতে। ভাইয়ের মৃতদেহ নিতে চান। বাংলাদেশের রানা অটোমোবাইলের কাস্টমার কেয়ার প্রধান মাহমদুর রহমান, আরেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও নুরুজ্জামান বাবুর মৃতদেহ নিতে এসেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সৌরভ আহমেদ। মর্গের সামনে মন খারাপ করে তিনি বসে ছিলেন। উড়োজাহাজটির কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের নানা এ মান্নান দুই দিন ধরে কাঠমান্ডুতে। তিনিও আছেন লাশের অপেক্ষায়। নিহত উম্মে সালমার স্বামী ঢাকায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর কর্মকর্তা মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলছেন। সিলেটের রাগিব-রাবেয়া মেডিকেলের নেপালি ছাত্রী সোয়েতা থাপার মা উর্মিলা প্রধান মেয়ের ছবি হাতে ধরে মর্গের সামনে বসে আছেন। সাংবাদিকদের বলেন, উড়োজাহাজটি যখন নামে, তখন তিনি বিমানবন্দরে ছিলেন। দেখছেন বিমান নামছে, মেয়ে নেমে আসবেন। হঠাৎ দেখেন বিমানে আগুন। আরও বলেন, ‘চোখের সামনে দেখলাম পুরো বিমানটি জ্বলছে।’ দুর্ঘটনায় নিহত একমাত্র চীনা নাগরিকের এক সহকর্মীও মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও জানেন না কবে লাশ পাবেন। এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় আহত ২০ জনের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একজনকে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মধ্য একজন বাংলাদেশিও রয়েছেন। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ, নেপাল ও উড়োজাহাজের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোম্বাডেয়ার যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে। বোম্বাডেয়ারের প্রতিনিধি গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ও নেপাল তদন্ত দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেপাল সরকার এ ঘটনায় ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। পরিস্থিতি নিয়ে নেপালে সফররত বাংলাদেশের বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল গতকাল নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাম বাহাদুর থাপা ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রাজেন্দ্র ছত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার ড্যাস ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৪ ক্রুসহ বিমানের ৭১ জনের সবাই হতাহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৬ বাংলাদেশি, ২৪ নেপালি ও ১ চীনাসহ ৫১ জন নিহত হয়েছেন। আর ১০ বাংলাদেশি, ৯ নেপালি, ১ মালদ্বীপের নাগরিকসহ ২০ জন আহত হন। আহত চিকিৎসক রেজওয়ানুল হককে গতকালই উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, আহত শাহরিন আহমেদ ঢাকায় ফিরে এসেছেন। ফলে এখন বাংলাদেশি আহত ৮ জন রইলেন নেপালে। কবে লাশ দেওয়া হবে টিচিং হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রমোদ চেস্টা বলেন, তাঁদের কাছে ৫১টি মৃতদেহ আছে। ১০ জনকে দেখে চেনা সম্ভব। অন্য ৪১ জনের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তাঁদের কোনোভাবেই চেনা সম্ভব নয়। নিহত সবার পরিবারের কাছে একটি করে ফরম দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তির শরীরে চেনার সম্ভাব্য যত চিহ্ন আছে, তা যেন উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সবার ময়নাতদন্ত শেষ হলে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে চেনার চেষ্টা করা হবে। যাঁদের চেনা যাবে, তাঁদের লাশ পরিবার বা দূতাবাসের কাছে দেওয়া হবে। আর যাঁদের চেনা যাবে না, তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। এ কাজে কত দিন লাগবে তা তিনি জানেন না। তবে বাংলাদেশের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল গতকাল দুপুরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, বাংলাদেশি নিহত ২৬ জনের মধ্যে ৮ জনের চেহারা চেনা সম্ভব। অন্যদের চেনা সম্ভব নয়। যাঁদের চেহারা চেনা যাবে, ময়নাতদন্তের পর তাঁদের লাশ দূতাবাসের কাছে দেওয়া হবে। আর যাঁদের চেনা সম্ভব নয়, তাঁদের ডিএনএ প্রোফাইল করা হবে। এ কাজের জন্য আজ ঢাকা থেকে একটি দল পাঠানো হবে। এতে বার্ন ইউনিট ও ডিএনএস বিশেষজ্ঞ থাকবেন। ডিএনএর মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই লাশ দেওয়া হবে। এতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। তবে ময়নাতদন্ত তিন দিনের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি জানান। নেপালের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রাজেন্দ্র ছত্রী গতকাল সকালে বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, যত দ্রুত সম্ভব লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। নেপাল সেনাবাহিনী এ কাজে সহায়তা করবে বলে তিনি জানান। নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস গতকাল বিকেলে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, স্বজনেরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করবেন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর মৃতদেহ দেওয়া হবে। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মনোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া চারজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। তাঁদের মধ্যে এমরানা কবির হাসির অবস্থা গুরুতর। তাঁর শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। কাঠমান্ডু মেডিকেলে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। হাসির স্বামী রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রকিবুল হাসান ঘটনাস্থলেই মারা যান। আশরাফ উদ্দিন নামে হাসির এর স্বজন বলেন, ‘জানি না কী হবে।’ হাসির পাশে পাশাপাশি রাখা হয়েছে রাগিব-রাবেয়া মেডিকেলের ছাত্রী প্রিন্সি ধামি। তাঁকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানান। গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের চিকিৎসক রাজ চক্র পান্ডে বলেন, তাঁর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুজনের অবস্থা গুরুতর। আহত কবির হোসেনের ছেলে হেলাল ইবনে কবির বলেন, তাঁর বাবা পা নাড়াতে পারছেন না। বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এসব হাসপাতাল থেকে চারজনকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নেপাল সরকারে ছয় সদস্যের কমিটি এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। এই দলে বাংলাদেশ ও বোম্বাডেয়ারের প্রতিনিধি আছেন বলে নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুরেশ আচারিয়া জানান। বোম্বাডেয়ারের দুই সদস্য গতকাল নেপালে এসেছেন। গতকাল তাঁরা বাংলাদেশের বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সিভিল অ্যাভিয়েশনের সদস্য (অপারেশন) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান ও পরামর্শক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ যুক্ত আছেন। তদন্তের ব্যাপারে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিমানমন্ত্রী বলেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মার সঙ্গে বৈঠকে তিনি সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার অনুরোধ করেছেন। নেপাল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আগে তদন্ত হোক, তারপর সব বলা যাবে।    

এ সম্পর্কিত আরও খবর