সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি যশোরে ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার। ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালা, কাঁচা-পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আঘাতের ১৫ দিন পার হলেও সেই ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই জেলার মানুষ। হাজারো মানুষ এখনো আশ্রয়হীন। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি সামলে ঘুরে দাঁড়ানোই মানুষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের দাবি, আম্পানের আঘাতে যশোর জেলায় ২৮৩ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিপুল ক্ষতির বোঝা সামলে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোয় এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন দফতরের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মণিরামপুর, শার্শা, অভয়নগর, কেশবপুর ও চৌগাছা উপজেলা। জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৮৩ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ঝড়ে গাছ উপড়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত আরও অর্ধশতাধিক মানুষ। এক লাখ ৬৭ হাজার ৫শ’ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমির ফসলহানি ও ৬৪ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট, ৩৩ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সেক্টরে ১৩২ কোটি ১২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৩২ হেক্টর মাছের পুকুর ও খামারে দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলায় বিদ্যুৎ লাইনের সম্পূর্ণ ক্ষতি ১৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও আংশিক ১৫৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইনের। ক্ষতির পরিমাণ ২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। জেলার ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে, ১৫৯টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও ৭৬টি মাদরাসায় ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জেলার ৫৫০টি গভীর নলকূপের তিন কোটি ৭১ লাখ টাকা। জেলায় অগভীর নলকূপ এক হাজার ২২০টি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৯৮ লাখ টাকা। হস্তচালিত নলকূপ ২৫টির ৬ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের ১৫টি মোবাইল টাওয়ারে ১৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৩৮৪টি মসজিদে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ও ৯৬৬টি মন্দিরে ১৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩০টি গীর্জায় ৮৫ হাজার ক্ষতি হয়েছে। যশোর জেলায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া ১১টি ব্রিজ কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৬ হাজার ৭৯৭টি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট, বিভিন্ন পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। একটি ক্লিনিক ও আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বারাকপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত। কৃষিতেই তার জীবন-জীবিকা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েছে তার জীবিকা। তার খেতের দুই বিঘা পেঁপে, এক বিঘা করলা (উচ্ছে), ২৫ কাঠা জমির তিল ও দুই বিঘা জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত। ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। এবার ভয়ঙ্কর ঝড় হয়েছে। আমার সব শেষ করে দিয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবো কি করে ভাবতে পারছি না। এই ঝড় ১৯৮৮ সালের ঝড়কেও হার মানিয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বোরো ধানের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিছু ধানের বীজতলা ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কাজ শেষে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। সরকারি সহায়তা পেলে তালিকায় অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হ্যাচারি মালিক ও ছোট-বড় মাছ চাষিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহয্য করা হবে।
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-২ জেনারেল ম্যানেজার অরুণ কুমার কুন্ড বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে ৩০২টি বৈদ্যুতিক পেটাল ভেঙে যায়। বৈদ্যুতিক লাইন নষ্ট হয়ে গেছে। দিন রাত কর্মীরা ছুটে চলছেন ভেঙে পড়া বিদ্যুৎ মেরামত করতে। এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় বিদ্যুৎ যায়নি জানতে চাইলে বলেন, সব গ্রাহকই দ্রুত বিদ্যুৎ পেয়ে যাবেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আম্পানের আঘাতে যশোরের ৮টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়নে কম-বেশি ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে যশোরের ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। কিছু এলাকায় ঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে যশোরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক লোক। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আট উপজেলায় টিন বিতরণ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভেঙে যায় ঘর ঠিক করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ বান টিন বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া খাদ্য সহায়তা হিসেবে ১০০ মেট্রিক টন চালও বিতরণ হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বার্তা২৪.কমকে জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে যশোরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ বহু স্থাপনা ভেঙে গেছে। অনেক গ্রামের কাঁচা রাস্তা পানির তোড়ে ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। জেলায় ৫ লাখ ৭৮ হাজার ২১৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের পরে এসব ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৩ শ’ বান টিন বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি টিনের বানের সঙ্গে ৩ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা স্ব-স্ব মন্ত্রালয়ের দফতরে চাহিদা পাঠিয়েছি।