আগের মতো জৌলুস নেই চামড়া প‌ট্টিতে

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, খুলনা | 2023-08-24 00:28:14

বিশ্বব‌্যাপী চামড়ার তৈরি পণ্যের দারুণ রকমের চা‌হিদা থাকলেও দেশে আচমকা কদর নেই কাঁচা চামড়ার। দেশের অন‌্যান‌্য স্থানের মতো খুলনাতেও কাঁচা চামড়া বি‌কি‌কি‌নি চলছে সস্তা দামে। এতে হতাশ হচ্ছেন চামড়া বেচা কেনার সাথে সং‌শ্লিষ্টরা। চামড়ায় রেকর্ড প‌রিমাণ দরপতনকে এ সমস‌্যার অন্তরায় হিসেবে দেখছেন তারা।

রোববার (০২ আগস্ট) খুলনার চামড়াপট্টি হিসেবে প‌রি‌চিত শেরে বাংলা রোডে ঘুরে দেখা যায়, সংগ্রহ করা চামড়ায় লবণ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবার মাত্র ৬ জন ব‌্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করায় আগের মতো জৌলুস নেই চামড়া প‌ট্টিতে। রেকর্ড পরিমাণ দরপতনে সারা দেশের ন্যায় খুলনা অঞ্চলেও এবারের কোরবানির চামড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। বিভাগীয় শহর খুলনায় যাতয়াত খরচের অর্ধেক দামে চামড়া বিক্রি করে হতাশ হচ্ছেন বিক্রেতারাও।

চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়ার দরপতনের কারণে খুলনাঞ্চলে গত বছরের মতোই এবারও চামড়ার কদর নেই। এ কারণে পাড়া-মহল্লা থেকে খুবই অল্প দামে চামড়া সংগ্রহ করেছে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। ছোট গরুর চামড়া কেনেননি কেউ। ছাগলের চামড়াও কেনাবেচা হয়নি। শুধুমাত্র বড় গরুর চামড়া কেনাবেচা হয়েছে, তাও আবার বিগত বছরে ছাগলের চামড়ার যেমন দাম ছিলো তা এবার বড় গরুর চামড়ায় দেওয়া হয়েছে। চামড়া বিক্রি করতে এসে পথ খরচও উঠেনি কোরবানি দাতাদের। পুঁজি হারিয়ে ও পশুর চামড়ার দরপতনে খুলনা শেখপাড়ায় চামড়ার বেশিরভাগ আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এবার ঈদে আগের মতো আয়োজন করে পশুর চামড়া কিনতে দেখা যায়নি চামড়া প‌ট্টিতে। খুলনা চামড়া প‌ট্টিতে অর্ধশতা‌ধিক ব‌্যবসায়ী আগে চামড়া সংগ্রহ করলেও এবার সে সংখ‌্যাটা মাত্র ৬ জন। আগে কোরবানির সময়ে চামড়া পট্টিতে লোকে লোকারণ্য‌্য থাকতো, এখন সেখানে সব‌কিছু নিষ্প্রাণ।

কাঁচা চামড়া বি‌কি‌কি‌নি চলছে সস্তা দামে

মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম বলেন, গত দুই/তিন বছর চামড়া কিনে বিরাট ধরা খাই‌ছি। এবার সবচেয়ে ভালো ও বড় মাপের চামড়া ১০০ থেকে ২৫০ টাকায় কিনেছি; তাতেও শুনতেছি লোকসান হতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীবার থেকে হয়তো আর চামড়া সংগ্রহ করতে পারবো না।

নগরীর খাদেমুল ইসলাম সিদ্দী‌কিয়া কা‌মিল মাদরাসার শিক্ষক আবুল ফজল শেখ বলেন, মাদরাসার জন‌্য সংগ্রহ করা চামড়া ইজিবাইকে করে নিয়ে এসেছিলাম শেরে বাংলা রোডের শেখপাড়া চামড়া পট্টিতে বিক্রি করতে। ৬০ টাকায় ইজিবাইক ভাড়া করে এসে সেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ৫০ থেকে ১২০ টাকায়। এতে লাভের লাভ তো কিছু হয়নি, বরং যাওয়া আসার খরচটাও উঠেনি। শ্রমও বৃথা, মাদরাসার জন‌্য কিছু সংগ্রহ হয়নি।

খুলনা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম ঢালী বলেন, ট্যানারি মালিকরা পাওনা অর্থ না দেওয়ায় পুঁজি সংকটে খুলনার ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী। যে কারণে তারা একটি চামড়াও কিনেননি। মাত্র ৬ জন ব্যবসায়ী প্রায় দশ হাজার পিস চামড়া কিনেছে এ বছর। আমি নিজেও বহু চামড়া ফেরত দিয়েছি, কিনিনি। খুলনার চামড়াগুলো ফুলতলা, নওয়াপাড়া, যশোর, নাটোর, ঢাকা অঞ্চলে বিক্রি করে থাকি।

তিনি আরও বলেন, এবার ৫০, ৬০, ৭০ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া আমরা কিনিনি। এক লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়া একশ, দেড়শ টাকায় কিনেছি। দেড় থেকে দুই লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়া এবার ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনেছি। বর্তমান যা বাজারমূল্য তাতে কোরবানি দাতারা যে চামড়া বিক্রি করতে আসবে, বিক্রয়মূল্যে তো রিকশা ভাড়া উঠবে না। সে কারণে চামড়া সব মাদরাসাগুলোতে দিয়েছেন সবাই। মাদরাসাগুলো কিছু ফ্রি পাইছে, কিছু কিনছে। তারা আমাদের কাছেও কিছু বিক্রি করতে পারে, আবার ফুলতলা সুপারটেক্স লেদার ও নওয়াপাড়ায় ট্যানারিতে বিক্রি করে। সেখান থেকে তারা অগ্রিম অর্থও নিয়েছিল।

চামড়ার বিকিকিনি চলছে

অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রসেসিংয়ে একটি চামড়ার পেছনে দুই থেকে তিনশ টাকা খরচ হয়। ক্রয়মূল্য ও প্রসেসিং খরচ দিয়ে সপ্তাহখানেক পর বিক্রি করতে গেলে বুঝবো; লোকসান হবে কি না? কিনতে গেলেও তো ভয়রে ভাই, ট্যানারি মালিকরা টাকা দেয় না। গত বছর ৭০ লাখ টাকার চামড়া দিয়ে একটি পয়সাও পাননি খুলনার চামড়া ব্যবসায়ী শফি। তিনি অর্থ সংকট ও ঋণের চাপে দুশ্চিন্তায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন, কথাও বলতে পারেন না। কয়েকজন ব্যবসায়ী মারাও গেছেন। খুলনার ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০ কোটি টাকা অনাদায়ী পড়ে আছে ট্যানারিতে। সরকার খুলনার প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীদের একটি পয়সা সহায়তা করেনি। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে ট্যানারি মালিকদের। অথচ চামড়া শিল্প রক্ষায় প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণও দেয়নি। ঈদের সন্ধ্যায় বৃষ্টি না হলে হাজার হাজার চামড়া নষ্ট হতো বলে যোগ করলেন তিনি।

ফুলতলার সুপার এক্স লেদার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুম মিয়া বলেন, খুলনার মাদরাসাগুলোর লবণ ছাড়া চামড়া কিনে নিজেরাই প্রসেসিং করতেছি। ঈদের দিন ১০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছি। পরিবহন সমস্যার কারণে ঈদের দিন সব মাল এসে পৌঁছায়নি, রোব ও সোমবারও কিছু চামড়া আসবে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মার্কেট খুবই খারাপ। ৪০ থেকে ৪৬ সেন্ট বিক্রয়মূল্য চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারে। সেখানে ৪৬ টাকা কেমিকেল খরচ। বিক্রয়মূল্য থেকে ক্রয়মূল্য যোগ অন্যান্য খরচ সমান সমান করলে দেখা যাচ্ছে- প্রতিটি চামড়া ২০-২৫ টাকা লোকসান থাকছে। সারাদেশের দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারবো না! সরকার আমাদের কোনো টাকাও দেয় নাই, ব্যাংক লোনও পাই নাই। আমরা চাইছি- খুলনার মাদরাসাগুলো বাঁচুক, এতিম শিশুগুলো কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করুক। খুলনার যতো মাদরাসা থেকে ফোন করছে, আমরা বলেছি- চামড়া দেন, ন্যায্য দামে শুধু আপনাদেরটাই (মাদরাসার) আমরা নেবো। সে কারণেই মাদরাসা ব্যতীত বাইরের একটি চামড়াও আমরা কিনছি না। খুলনার মাদরাসাগুলো বাঁচানোর জন্য শুধুমাত্র তাদের চামড়াগুলো কিনেছি।

চলছে চামড়া সংগ্রহের কাজ

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, ব্যবসায় লাভ লোকসান থাকে। এবার হয়তো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসান করবে না। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ ঘরবন্দী থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। অধিকাংশ মানুষ এখন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান এই তিনটি নিয়ে ভাবছে। জুতা বা চামড়ার পণ্য ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে কেউ নেই। পৃথিবীর নামি-দামি শো’রুমগুলো বন্ধ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করেছি। কারণ, এসময়ের সংগৃহীত চামড়া দিয়েই আমাদের সারা বছর কাজ করতে হয়। ফ্যাক্টরি চালু রাখতে হয়। শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। সে কারণে ট্যানারি মালিকরাও লোকসান ঝুঁকিমুক্ত নন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

উল্লেখ‌্য, ২০১৪ সালেও কোরবানির ঈদে দেশে গরুর চামড়ার বর্গফুট প্রতি দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা। চলতি বছর তা নেমে এসেছে ৩৫-৪০টাকায়। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে গরুর চামড়ার দাম ৫০ শতাংশ কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর গত বছরের তুলনায় দাম কমেছে ২৯ শতাংশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর