আগুন সন্ত্রাসের ঘূর্ণিপাকে বিএনপি

বিএনপি, রাজনীতি

আকরাম হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-27 17:16:35

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয় কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন। উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মাঠের রাজনীতিতে এখনো ফেরেনি প্রাণ। ঘরোয়া ও ভার্চুয়াল রাজনীতি থেকে বের হয়ে মাঠের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ও ঢাকা-১৮ আসনের উপ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিত দেখাতে সক্ষম হয় দলটি। তবে ভোটের দিন ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ছাড়া কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনতেও সফল হয়নি তারা। ফলে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

এদিকে, ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন আলোচনার কেন্দ্রে আসে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়। ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে যখন ভোট গ্রহণ চলছে তখন রাজধানীর কয়েকটি স্থানে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। হঠাৎ বাসে অগ্নিসংযোগের ফলে রাজনীতিতে আবারো উত্তাপ সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে তেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চলছে নানা বিশ্লেষণ।

অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়। ওইদিন বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুকসহ মোট ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘেরাও করে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ মামলায় বিএনপির প্রায় ৪০০ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩২ জনকে। এদের মধ্যে ২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। বাসে অগ্নিসংযোগের পিছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছে এই মুহূর্তে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের শক্তি নেই বিএনপির। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল এটি। আবার বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা বলে মনে করছেন কেউ।

বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে বাসে অগ্নিসংযোগ নতুন ঘটনা নয়। এর আগে জামায়াতসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা চরমে পৌঁছায়। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি ও বিএনপি সমর্থিত জোট। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ চলছে। একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে চারিদিক। এসময় এর দায় পড়ে বিএনপির ওপর।

দলটি এসব অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসছে। বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বানচাল করতে অন্য মহল থেকে এ অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে দাবি করে তারা। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির আন্দোলনে বাসে অগ্নিসংযোগের চেষ্টায় বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। পেট্রোল বোমাসহ বিএনপি-শিবির কর্মীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কর্মীও ধরা পড়ে এসময়। বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করে বিএনপি। সে দাবি আর আলোর মুখ দেখেনি।

পরবর্তীতে এসব ঘটনা ধামাচাপা পরে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে পেট্রোল বোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে অগ্নিসংযোগ দেখা যায়নি। গত ১২ নভেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১০টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যার ফলে পুরোনো হিসেব নতুন করে সামনে চলে আসে। এবারও অভিযোগের আঙুল বিএনপির দিকে। আগুন সন্ত্রাসের ঘূর্ণিপাকে আবারও হাবুডুবু খাচ্ছে দলটি।

সম্প্রতি রাজধানীতে বাসে অগ্নিসংযোগ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এটাকে অ্যাটেনশন ডাইভারসন টেকনিক বলে। আমি আগেই বলেছি, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের বোঝানোর চেষ্টা যে, দেশে সন্ত্রাসী আছে, আমরা (আওয়ামী লীগ) ছাড়া কোনো উপায় নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় বাসে যে অগ্নিসংযোগ হয়, তা বিএনপি যেমন করেছে তেমনি সরকারও অর্ধেক করেছে।

রাজনৈতিক দায় চাপানো আওয়ামী লীগের বহু পুরানো অভ্যাস বলে মনে করেন বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। বার্তা২৪.কম-কে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের দায় চাপানো শুরু হয়েছে। এখন অবধি চলছে। আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি হওয়ায় এ দায় বিএনপির ওপরে চাপাচ্ছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ভিডিও ফুটেজ দেখে দেখে ব্যবস্থা নিবে। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন এটা বিএনপির কাজ। এখানে তো সরকারের মধ্যেই দুইটা অংশ হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যখন আন্দোলন হয়েছে তখন আমরা গাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখেছি। সেখানে একটি ইন্টারেস্টিং অধ্যায় আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। আমাদের মনে আছে, গাড়িগুলো আসতো পুলিশ-বিজিবি র‌্যাবের টহলে। তারা টহল দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৩০-৩৫টা গাড়িবহর ঢাকা নিয়ে আসতো। সেখানে আগুন জ্বলেছে, তাহলে কি সেই আগুন বিএনপি দিয়েছে?

তিনি বলেন, দায় চাপানো তো খুব সহজ। তদন্তের আগেই যদি দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সেটা তো মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেল। সেটা তো আসল বিচার হলো না। তারা ভিডিও ফুটেজ দেখে বের করুক। সেটা তো আমরাও চাচ্ছি।

‘আগুন সন্ত্রাসের দায় সব সময় বিএনপির ওপরে পড়ছে’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখান থেকে বের হওয়ার দায় বিএনপির নেই। আগুন সন্ত্রাসের দায় থেকে বিএনপি বের হতে পারছে কিনা সেটা আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করলো কি না, মিডিয়া বিশ্বাস করলো কি না, সেজন্য আমাদের কোনো যন্ত্রণা নেই। এটা পরীক্ষা করার একমাত্র উপায় হল একটা নিরপেক্ষ সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন। মতামত প্রকাশের একটা সুযোগ দিক, তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে জনগণ কি বিএনপিকে আগুন সন্ত্রাসী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে নাকি বিএনপির ওপর অহেতুক দায় চাপানো হচ্ছে । এছাড়া প্রমাণের আর কোনও জায়গা নেই।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, বিএনপি কোনো সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না। বিএনপি গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে। বিএনপি সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চায়, এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে বিএনপি কখনোই জড়িত নয়। বিএনপি ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে নয়, বরং জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রাজনীতি করে। বিএনপিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে সরকার দলটির ওপর দায় চাপায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর