কাজী মামুন তুমি কার?

জাতীয় পার্টি, রাজনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-10-31 09:48:27

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যূর ৪ মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট পার্কে (বারিধারার বাসভবন) হঠাৎ করেই ঢুকে পড়েন বিদিশা সিদ্দিক। উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সভায় আলোচনা ওঠে।

ওই বৈঠকে প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ বেশ জোরালো ভাষায় বিদিশার সমালোচনা করেন। জাতীয় পার্টির এতো এতো নেতাকর্মী থাকতে বিদিশাকে বের করতে না পারায় খানিটা তাচ্ছিল্যের সূরে কথা বলেন। এমনকি বিদিশাকে টেনে হিঁচড়ে বের করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

ওই ঘটনার মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সবাইকে অবাক করে বিদিশার দলে ভেড়েন কাজী মামুন। অল্পদিনের মাথায় বিশাল সম্পদে গড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে আর্বিভূত হন। এরপর বিদিশার পক্ষে চলে তার নানা রকম বাগাড়ম্বর। বক্তৃতা বিবৃতিতে জিএম কাদেরকে তুলোধুনো করতে থাকেন। বিদিশাকে সঙ্গে নিয়ে হঠাৎ করেই জাতীয় পার্টির নতুন কমিটি ঘোষণা দিয়ে বসেন। সেই কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব নেন কাজী মামুন। নতুন কমিটির ব্যানারে নানা আয়োজনে বিদিশার পাশে দেখা যায় মামুনকে। খোদ রংপুরে গিয়ে এরশাদের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসেন।

কয়েক মাস না যেতেই বিদিশার সঙ্গে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এবার ট্রাস্ট পরিচালনা ও অন্যান্য ইস্যুতে তাদের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও সাংবাদিক সম্মেলন। এরপর তরী ভেড়ান রওশন এরশাদের ডেরায়। ওই সময়ে রওশন এরশাদ ছিলেন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। সেখানে গিয়ে ধর্ণা দিতে থাকেন, চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর কথা বলে যোগসূত্রও পেয়ে যান মামুন।

ওই সময়ে হঠাৎ করেই নভেম্বরে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল (২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর) করার ঘোষণা দেন রওশন এরশাদ। এক তরফাভাবে একটি প্রস্তুতি কমিটিও ঘোষণা করেন। যেখানে সদস্য সচিব করা হয় সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ্ কে। সেই সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় কাজী মামুনকে।

রাজধানীর গুলশানের ৪৭ নম্বর রোডে ভাড়াবাড়িতে বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপন করেন। সেখান থেকে চলতে থাকে নানা রকম কর্মকাণ্ড। অতীতে রওশনপন্থীরা একাট্টা থাকলেও মামুনের কূটচালের কারণে নানা সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। হঠাৎ করে রওশনকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা এবং পরে প্রত্যাহার ও তারই কূটচালের অংশ মনে করেন অনেকেই।

রওশন এরশাদের এই ঘনিষ্ঠতার সময়েও গোপনে জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাজী মামুন। হোটেল সোনারগাঁওতে ওই বৈঠকে নিজের বক্তব্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমাও চান বলে জিএম কাদের’র ঘনিষ্ঠরা দাবি করেছে। ইদানিং নাকি বিদিশার সঙ্গেও ফের যোগাযোগ বাড়ছে। যে কারণে তাকে আর কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন মামুন তুমি কার।

নিজেকে জাহির করতে সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের কথা বলে বেড়ান। হরহামেশাই নাকি সরকার প্রধান তাকে ফোন দিয়ে আলোচনা করেন এমনভাবও দেখান।

কে এই মামুন!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান কাজী মামুন। তার বাবাকে কেউ কেউ বর্গচাষি বলে উল্লেখ করেছেন। এক দশক আগেও টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন। কথিত রয়েছে ওই কোম্পানির কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে সটকে পড়েন তিনি।

২০১৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। প্রথম ধাপেই জাতীয় যুব সংহতির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ বাগিয়ে নেন। কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র ৬ মাসের মাথায় পার্টির শিল্প ও বাণিজ্যি বিষয়ক সম্পাদক পদ পেয়ে যান। সর্বশেষ জাপার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াসের সদস্য হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন বাগপটু মামুন।

দলীয় পদের পাশাপাশি একই সঙ্গে এরশাদকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদারিতে নেমে পড়েন। এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষার জন্য এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্ক বাসভবনের ৪ তলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সকাল বিকেল এরশাদের সাক্ষাতের মাধ্যমে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সুযোগ পান।

তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের (বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বাবা ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর বাবা এম এ মালেক এরশাদের আনুকূল্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। সেই পুরনো সূত্র ধরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মামুনকে পরিচয় করে দেন। তাকে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। চতুর কাজী মামুনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পুরুষদের জন্মনিরোধকসহ নানা উপকরণ সরবরাহ দিতে থাকেন একচেটিয়া। এক সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক চড়াদর আদায় করতে থাকেন।

ঢাকার মৌচাক এলাকায় অবস্থিত ফরচুন শপিং মলে ৪টি ফ্ল্যাট, ২টি দোকান, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সামনে রূপায়নের একটি বিল্ডিংয়ের সাড়ে ৩ কোটি টাকার ফ্ল্যাট, বারিধারায় পার্ক রোডে ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে বিপুল পরিমাণ জমিসহ নামে বেনামে বহু সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। তার বিরুদ্ধে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী নারী সম্প্রতি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, তার কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, আবার নীতি আদর্শও নেই। স্যারকে (এরশাদ) দিয়ে কিছু টাকা কামাইছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এখন এমপি হওয়ার খায়েশ হইছে, কখন কাকে ধরছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। যখন যার কাছে গেলে সুবিধা পাবে তখন তার কাছে ভিড়েছে। প্রকৃত কাজী বংশও না, বিয়ে পড়ানো কাজী। নিজেও ৪টি বিয়ে করেছে। মায়ের বয়সী এক নারীকেও বিয়ে করেছে। সম্প্রতি এক নারীকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে বলে শুনেছি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিক দফায় ফোন দিলেও রিসিভ করেননি কাজী মামুন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর