জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এক মাস ধরে রহস্যজনক নীরবতা পালন করছেন। সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর এক যোগদান অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। তারপর থেকে রহস্যজনকভাবে আর মিডিয়ার সামনে আসছেন না তিনি।
তবে ১৪ নভেম্বর আইডিইবি ভবনে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের যৌথসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তবে সেই সভায় মিডিয়ার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সে হিসেবে মুখবন্ধ রাখার এক মাস পূর্তি করলেন জিএম কাদের। এমনকি সাংবাদিকদের ফোনও এড়িয়ে চলছেন। যা তার ক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম। ফোন দিলে ধরতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে ফিরতি কল করা তার স্বভাবজাত অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। সে সব ফোনও এখন এড়িয়ে চলছেন।
কেনো তার এই নীরবতা এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, পার্টির মুখপাত্র হিসেবে আমি কথা বলছি। এসব কথা তার নির্দেশনা অনুযায়ী বলছি। কি বলতে হবে তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিচ্ছি। পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি কি সব সময় কথা বলেন।
রাজধানীর বনানীস্থ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে তার উপস্থিতি নিত্যদিনের চিত্র হলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই তার চলাফেরা বেশ রহস্যজনক। ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর টানা কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকেন। উত্তরার বাসা এবং বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপের খবর আসে। নির্বাচন কমিশন তফসিল দিলে জাপা নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। তখন পার্টির মুখপাত্র চুন্নু নিয়মিত ব্রিফিং করতেন, তার বক্তব্যের সারাংশ থাকত, সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পেলে, আর ভোটের পরিবেশ তৈরি হলে জাপা অংশ নেবে।
জাতীয় পার্টির ১৯ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার পর গুমোট পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটে। একটু একটু করে অফিসে আসা-যাওয়া শুরু করেন জিএম কাদের। তবে মিডিয়া এড়িয়ে চলছেন পুরো সময়। হঠাৎ অফিসে হাজির হন, আবার দ্রুত বের হন, কোথায় যান কেউ বলতে পারেন না। এমনও দিন দেখা গেছে দফায় দফায় আসা যাওয়া করছেন। তবে কোথায় যাচ্ছেন, কেনো যাচ্ছেন পার্টির লোকজনকেও জানানো হয়নি।
শুধু পার্টির চেয়ারম্যানই নয়, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা অনেকেই একই কৌশল নিয়েছেন। মহাসচিব নিয়মিত অফিসে হাজির হচ্ছেন মিডিয়া এলে কথা বলছেন, কখনও বেরিয়ে যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরে আসছেন তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই।
দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি এবং সাক্ষাতপর্ব পর্যন্ত বনানী চেয়ারম্যানের অফিস ছিল জমজমাট। ২৭ নভেম্বর দলীয় প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করার পর এখন কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রার্থীরা অনেকেই এলাকায় চলে যান মনোনয়নপত্র দাখিল করতে। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক, জিএম কাদের গণভবনে যাওয়ার খবর এবং আসন সমঝোতার খবর রটে যাওয়ায় বনানীতে আবার ভিড় বাড়তে শুরু করেছে।
কয়েকজন প্রার্থীকে সারাদিন আসা-যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহ-৫ আসনের বর্তমান এমপি সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, কুমিল্লা-২ আসনের এমপি আমির হোসেন, জামালপুর-২ আসেন প্রার্থী মোস্তফা আল মাহমুদকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। তারা সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনও তাদের গাড়িতে করে বাইরে যাচ্ছেন। অফিসে ধর্না দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি। তিনি কখনও মহাসচিবের রুমে, কখন নিচের ওয়েটিং রুমে, কখনও উপরের প্রেস উইংয়ে উদাস হয়ে বসে থাকছেন। কখনও আবার রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছেন।
পার্টি সূত্র জানিয়েছে, অনেকেই মনে করছেন সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতা হবে। সমঝোতার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ কিছু আসন ছেড়ে দেবে। যেখানে নৌকা মার্কা থাকবে না। আর নৌকা না থাকার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত বিজয়। প্রার্থীরা অনেকেই সমঝোতার তালিকায় নিজের নাম লেখাতে তৎপর। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। লবিং তদবির চালাচ্ছেন।
তবে সমঝোতার এই গুঞ্জনে আরেকটি গ্রুপ বেজায় চটেছেন। তারা সিনিয়র কাউকে পেলে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ার চেষ্টা করছেন। বলার চেষ্টা করছেন, অনেকেই সমঝোতা করে এমপি হবেন, আমরা তাহলে কেনো নির্বাচন করবো।
প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন এমনি ক্ষুব্ধ একজন। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, অনেক এমপি আছেন যারা জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেননি। তাদের পোস্টারে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করেন। ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) আর্শিবাদ পেয়ে এমপি হয়েছেন। তাদেরকে যদি আবার এমপি বানানো হয়, তাহলে দল করে কি লাভ হলো, আর ভোটেই বা করবো কেনো। যদি সমঝোতা হয় তাহলে শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাবেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ১১ নভেম্বর বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার কোনো আলাপের বিষয়ে আমার জানা নেই। রাজনীতিতে চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু ঘটতে পারে। নির্বাচন করার জন্য এসেছি সরে আসার জন্য নয়। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি হলে যে কোন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। জাপা মহাসচিব উদ্ভূত পরিস্থিতির কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
নানা নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে নির্বাচনে আসা জাতীয় পার্টি ২৯৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন দেন। দলীয় টিকেট পেলেও ৬ জন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। ছেলে সাদ এরশাদের আসন নিয়ে টান দেওয়া এবং অনুসারীদের মনোনয়ন নিশ্চিত না হওয়ায় ২৯ নভেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান রওশন এরশাদ। নির্বাচন কমিশন বাছাই শেষে ২৭২ আসনে জাপার প্রার্থীদের বৈধ ঘোষণা করেছে।
দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি সরকারের ওপর আস্থার সংকটে ভুগছে জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা মনে করেন ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ কোন নির্বাচনেই প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি আওয়ামী লীগ। নানাভাবে তাদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। উপনির্বাচন, উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত কোথাও ছাড় দেওয়া হয়নি। অতীতে অনেক নির্বাচনে জাপার প্রার্থীদের জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করবে সে সম্পর্কে তাদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যে কারণে জাতীয় পার্টি আগে ভাগেই নিশ্চিত হয়ে তারপর সিদ্ধান্ত দিতে চায়। তারা এমন কোন মাধ্যমে নিশ্চিত হতে চান যাতে, আওয়ামী লীগ আর প্রতিশ্রুতি ভাঙতে না পারে। সে কারণে অনেকেই ২০১৪ সালের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন। ওই নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলের পর হঠাৎ করে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। তবে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ৮৭ জন প্রার্থী মাঠে থেকে যায়। পরে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করেন।