কে-কে টিক মার্ক পাচ্ছেন, কতজন পাচ্ছেন সে আলোচনাই জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। টিক মার্কের প্রভাব নিয়েও চলছে তর্ক-বিতর্ক, ক্ষোভও।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) বেলা ৩টায় জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ের তৃতীয়তলায় বসে যুক্তিতর্কে মেতে ওঠেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী সালাহ উদ্দিন খোকা ও বরিশাল-১ আসনের প্রার্থী ছেরনিয়াবাত সেকেন্দার আলী।
একজন বলে উঠলেন, জানেন আমার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে, আমি বাঘের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছি। আরে রাখেন আপনার বাঘ, আমি সিংহের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছি, যার ভয়ে পুরো দেশ কাঁপে। রূপক অর্থে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে বাঘ আর শামীম ওসমানকে সিংহ হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থী। তারপর মিনিট খানেক চলে বাঘ-সিংহ বলার পক্ষে যুক্তি-তর্ক। এক দুই কথার পরই শুরু হয় টিক মার্কের আলোচনা।
সালাহ উদ্দিন খোকা বলেন, টিক মার্কের (সমঝোতায় পাওয়া আসন) বিষয়টি গোপন থাকবে না। এতে অন্য প্রার্থীরা হতাশ হয়ে পড়বেন। যখন জানতে পারবেন তিনি টিক মার্কের তালিকায় নেই, তাহলে কেনো নিজের পয়সা খরচ করে নির্বাচন করবেন! যারা টিক মার্ক পাচ্ছেন না তারা নির্বাচন থেকে সরে যাবেন। দেখা যাবে বেশিরভাগ প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে গেছেন।
ছেরনিয়াবাত সেকেন্দার আলী বলে উঠলেন, ৩০০ আসনে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টির লাভ বেশি। প্রত্যেকটি আসনে সংগঠন তৈরি হতো। প্রার্থীরা পুরাতন কমিটি সক্রিয় করবেন, আবার যে সব জায়গায় কমিটি নেই সেখানে কমিটি করবেন। এতে পার্টির লাভ হতো। এককভাবে লড়লে জাতীয় পার্টির লাভ বেশি হতো। আমি মনে করি টিক মার্কের ঘটনা ঘটলেও সবাই সরে যাবে না। আমি যদি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বিরুদ্ধে ২০ হাজার ভোটও পাই তাহলে জনগণের কাছে এমপি।
তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠলেন আপনার ধারণা ভুল। গোপন সমঝোতা করে কিছু লোক এমপি হবে আর আমরা ডামি প্রার্থী জেনে মাঠে থাকবো। এটা ভাবলেন কি করে। কারা কারা টিক মার্ক পাচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে। ওরাই পার্টি করুক।
অনেকেই মনে করছেন সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতা হচ্ছে। সমঝোতার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ কিছু আসন ছেড়ে দেবে। যেখানে নৌকা মার্কা থাকবে না, আর নৌকা না থাকার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত বিজয়। প্রার্থীরা অনেকেই সমঝোতার তালিকায় নিজের নাম লেখাতে তৎপর। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তালিকায় নিজের নাম লেখাতে লবিং তদবির চালাচ্ছেন। গুঞ্জন রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্যরাই থাকছেন টিক মার্কে এগিয়ে।
তবে সমঝোতার এই গুঞ্জনে আরেকটি গ্রুপ বেজায় চটেছেন। তারা সিনিয়র কাউকে পেলে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ার চেষ্টা করছেন। বলার চেষ্টা করছেন, অনেকেই সমঝোতা করে এমপি হবেন, আমরা তাহলে কেনো নির্বাচন করবো, কেনো রাজনীতি করবো।
প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন এমনি ক্ষুব্ধ একজন। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, অনেক এমপি আছেন যারা জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেননি। তাদের পোস্টারে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করেন। ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) আর্শিবাদ পেয়ে এমপি হয়েছেন। তাদেরকে যদি আবার এমপি বানানো হয়, তাহলে দল করে কি লাভ হলো, আর ভোটেই বা করবো কেনো। যদি সমঝোতা হয় তাহলে শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাবেন।
নানা নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে নির্বাচনে আসা জাতীয় পার্টি ২৯৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন দেয়। দলীয় টিকেট পেলেও ৬ জন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে বিরত রয়েছেন। নির্বাচন কমিশন বাছাই শেষে ২৭২ আসনে জাপার প্রার্থীদের বৈধ ঘোষণা করেছে। আপিলে ৬ জনের মতো প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। ছেলে সাদ এরশাদের আসন নিয়ে টান দেওয়া এবং অনুসারীদের মনোনয়ন নিশ্চিত না হওয়ায় ২৯ নভেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান রওশন এরশাদ।
আসন সমঝোতা নিয়ে কয়েকদিন ধরেই দর-কষাকষি চলছে বলে গুঞ্জন চলছে। দফায় দফায় বৈঠকও চলছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ৭০ আসনের তালিকা দিলেও আওয়ামী লীগ ৩০ থেকে ৩৫ আসনে আটকে রয়েছে। জাপার দাবি হচ্ছে ছাড় দেওয়া আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে স্বতন্ত্রের বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই।
এতে করে আস্থার সংকটে ভুগছে জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা মনে করেন ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ কোন নির্বাচনেই প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি আওয়ামী লীগ। নানাভাবে তাদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। উপনির্বাচন, উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত কোথাও ছাড় দেওয়া হয়নি। অতীতে অনেক নির্বাচনে জাপার প্রার্থীদের জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করবে সে সম্পর্কে তাদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যে কারণে জাতীয় পার্টি আগে ভাগেই নিশ্চিত হয়ে তারপর সিদ্ধান্ত দিতে চায়। তারা এমন কোনো মাধ্যমে নিশ্চিত হতে চান যাতে, আওয়ামী লীগ আর প্রতিশ্রুতি ভাঙতে না পারে। তা নাহলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যেও বিষয়টি সামনে এসেছে।
জাতীয় পার্টির কোন কোন নেতা মনে করছেন ২০১৪ সালের মতো শেষ মুহূর্তে গিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারেন জাতীয় পার্টি। তবে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় কতজন মনোনয়ন প্রত্যাহার করবে সে নিয়ে সিনিয়র নেতারা যথেষ্ট সন্দিহান। তারা মনে করছেন ২০১৪ সালে যেমন রওশনের নেতৃত্বে ৮৭ প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে ছিলেন, এবার এই হার বাড়তে পারে। কারণ ২০১৪ সালে এরশাদের আদেশ অমান্য করে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের শাস্তির বদলে সবাইকেই পুরস্কৃত করা হয়েছিল।
নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, কোন সম্ভাবনা নেই। আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। সরে যাওয়ার জন্য নির্বাচনে আসিনি।