আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে গোপনীয়তাকে সন্দেহের চোঁখে দেখছেন জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী। আগে-ভাগে প্রকাশ হয়ে গেলে ক্ষুব্ধ প্রার্থীরা সরে যেতে পারেন এই ভয়ে রাখ-ঢাক বলে মনে করছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক প্রার্থী বার্তা২৪ ডট কমকে বলেছেন, জাতীয় পার্টি এখন নিজের কর্মীদের সঙ্গেই নাটক শুরু করেছে। সবকিছু ঠিক হলেও কেউই মুখ খুলছে না। আগামীকাল (১৭ ডিসেম্বর) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। হয়তো এমন সময়ে ঘোষণা দেওয়া হবে যখন আর প্রার্থীরা সরে যেতে না পারেন। প্রার্থীদের সরে যাওয়া আতঙ্কে এমন কৌশলী অবস্থান।
খোদ পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এর আচরণও তারা সন্দেহের চোঁখে দেখছেন। তারা বলেছেন, যে চেয়ারম্যানের সঙ্গে যখন খুশি সাক্ষাৎ করা যেতো, কথা বলা যেতো। সেই চেয়ারম্যান যতক্ষণ দ্বিতীয়তলার অফিস কক্ষে থাকেন, তখন দ্বিতীয়তলায় প্রবেশের মূল ফটক বন্ধ করে রাখা হয়। সাক্ষাৎ দেন বুঝে-শুনে।
সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর এক যোগদান অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন জিএম কাদের। তারপর থেকে আর মিডিয়ার সামনে আসছেন না। ১৪ নভেম্বর আইডিইবি ভবনে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের যৌথসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তবে সেই সভায় মিডিয়ার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।
জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা গেছে। পার্টির চেয়ারম্যানের রহস্যজনক নিরবতা সংশয় বাড়ছে নির্বাচন নিয়ে। অনেক প্রার্থী মনে করছেন আগামীকালও (১৭ ডিসেম্বর) ইউটার্ন নিতে পারে জাপা। প্রতীক বরাদ্দের চিঠি ইস্যু না করায় সেই সন্দেহ আরও জোরালো হচ্ছে। অনেক প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দের চিঠির জন্য এলেও তাদের দেওয়া হচ্ছে না।
আসন সমঝোতা হলে কি হবে, আর না হলে কি হবে সে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন অনেকেই। প্রায় সবার ধারণা সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় যাচ্ছে জাপা। সমঝোতার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ কিছু আসন ছেড়ে দেবে। যেখানে নৌকা মার্কা থাকবে না, আর নৌকা না থাকার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত বিজয়। প্রার্থীরা অনেকেই সমঝোতার তালিকায় নিজের নাম লেখাতে তৎপর। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তালিকায় নিজের নাম লেখাতে লবিং তদবীর চালাচ্ছেন।
আবার নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে এমন শঙ্কাও অনেক প্রার্থীর মধ্যে। তাদের ধারণা কাঙ্কিত আসন পেলে দফায় দফায় বৈঠকের প্রয়োজন হতো না। আর কাঙ্খিত আসন না পেলে নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারেন জিএম কাদের। তারা অনেকেই বনানীতে ভিড় করছেন জানার চেষ্টা করছেন আসলে নির্বাচনে যাবে কিনা। নির্বাচন প্রশ্নে নিশ্চিত হয়ে তারপর মাঠে টাকা খরচ করতে চান।
বৃহত্তর রংপুরের এক প্রার্থীকে কয়েকদিন ধরেই বনানীতে দেখা যাচ্ছে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল কেনো এসেছেন বনানীতে, এখনতো মাঠে থাকার কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, পার্টি নির্বাচন করবে কিনা বুঝতে পারছি না। কোন খবরও পাচ্ছি না। তাই বনানীতে এসে নিশ্চিত হতে চাই, আর প্রতীক বরাদ্দের চিঠি নেবো। কখন প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দেওয়া হবে কিছুই জানানো হচ্ছে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সামান্য কিছু পোস্টারের অর্ডার দিয়েছি। ভরসা পাচ্ছি না বেশি পোস্টারের অর্ডার দিতে।
নোয়াখালীর একজন প্রার্থী বলেন, যা চলছে তাতে পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর এখন মাঠ চষে বেড়ানোর কথা। গণসংযোগ বন্ধ থাকলেও নির্বাচনী অফিস স্থাপন, সেন্টার কমিটি গঠনসহ অনেক কাজ করার আছে। আর আমরা অনিশ্চয়তার কারণে ঢাকায় বসে সময় পার করছি। এমনিতেই আমরা পেছনে পড়ে রয়েছি, মাঠে না থেকে আরও পিছিয়ে যাচ্ছি।
পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রতিদিন নিয়মিত ব্রিফিং করে ৩০০ আসনে নির্বাচনের কথা বললেও প্রার্থীরা কেউই তা বিশ্বাস করছেন না। কে-কে টিক মার্ক (সমঝোতায় পাওয়া আসন) পাচ্ছেন, কতজন পাচ্ছেন সে আলোচনাই জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। টিক মার্কের প্রভাব নিয়েও চলছে পক্ষে বিপক্ষে তর্ক। অনেকেই মনে করছেন টিক মার্কের বিষয়টি গোপন থাকবে না। এতে অন্য প্রার্থীরা হতাশ হয়ে পড়বেন। যখন জানতে পারবেন তিনি টিক মার্কের তালিকায় নেই, তাহলে কেনো নিজের পয়সা খরচ করে নির্বাচন করবেন! যারা টিক মার্ক পাচ্ছেন না তারা নির্বাচন থেকে সরে যাবেন। দেখা যাবে বেশিরভাগ প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। এতে পার্টির জন্য হিতের বিপরীত হতে পারে।
আসন সমঝোতার গুঞ্জন নিয়ে দুপুর দু'টার দিকে বনানী পার্টি অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেন বেশকিছু কেন্দ্রীয় নেতা। শ্লোগান দেন দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ। আপোষ না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম। দালালের চামড়া, তুলে নেবো আমরা ইত্যাদি।
শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিসহ নানান বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক চলছে। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত আরও বৈঠক হবে। আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা হয় নি এ কথা বলবো না। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে স্পিকার ও বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানদের আসনে অন্যদের প্রার্থী না দেওয়ার অনেক নজীর রয়েছে। অনেক সময় প্রতিপক্ষ হলেও আসন ছাড় দেওয়ার রীতি দেখা গেছে। আমরাও কিছু আসনে তেমন কিছু করতে পারি কিনা সে আলোচনাও হয়েছে। আজকে আরও একটি বৈঠক হবে।
আলোচনার টেবিলে কতটি আসন এসেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এসব বিষয়ে এখনই কিছু বলতে চাচ্ছি না। প্রেম করার সময় সবকিছু গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। আগেই সবাইকে জানালে সেটি সফল হওয়া কঠিন।