জাতীয় পার্টির ঠিক কতজন প্রার্থী এখন নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রয়েছে তার কোনো উত্তর কারো কাছেই নেই। কারণ প্রতিদিনই নির্বাচনী মাঠ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রার্থীরা।
বড় একটি গ্রুপ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেই সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে তারা সরে এসেছেন। পার্টির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দাবি করেছে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন এমন আসনের সংখ্যা ২০০ এর কম হবে।
জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা আজকে (৩০ ডিসেম্বর) হিসাব করে দেখেছি সক্রিয়ভাবে মাঠে রয়েছে ১৫৬ জন প্রার্থী। আরও অনেকে রয়েছেন তবে জোরালো ভাবে নেই।
জাপা ২৯৪ আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিলেও সিলেট-৪ আসনের প্রার্থী প্রেসিডিয়াম সদস্য এটিইউ তাজ রহমান, কক্সবাজার-২ আসনের প্রার্থী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহমুদুল করিম, চাঁদপুর-৫ আসনে জাতীয় কৃষক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ওমর ফারুক, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খুররম ভুঁইয়া, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি জয়নাল আবেদীন এবং ফেনী-১ আসনের প্রার্থী ফজলুল করিম মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে বিরত থাকেন। নির্বাচন কমিশন বাছাই শেষে ২৭২ আসনে জাপার প্রার্থীদের বৈধ ঘোষণা করে। ৬ জন আপিলে প্রার্থীতা ফিরে ফেলে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭৮ এ। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে (১৭ ডিসেম্বর) কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত ২৬৫ আসনে প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দ পান বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি। যখন ওই ঘোষণা আসে তখন আর প্রত্যাহারের সুযোগ ছিল না। ওই ঘোষণার পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন ২৬ আসনের বাইরে থাকা সাধারণ প্রার্থীরা। ওই প্রার্থীরা মনে করছেন, তাদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টি এখন শুধু নির্বাচনে বৈধতা দেওয়ার প্রশ্নে। সে কারণে তারা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রচারণা চালাতে রাজি নন। পার্টি তহবিল দিলে নির্বাচনী মাঠে থাকবেন, না হলে সরে যাবেন।
প্রথম কয়েকদিন মনে করেছিলেন পার্টির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায় যোগাযোগ শুরু করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। এতে কোনো সুরাহা না হওয়ায় প্রার্থীরা এলাকা ছেড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় বনানীতে ভিড় করতে শুরু করেন। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সাক্ষাৎ না পেয়ে বিক্ষুদ্ধ প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক করে।
ক্ষুব্ধ প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় চল্লিশ জন ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মপুরে বৈঠক করেন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুর কার্যালয়ে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ঢাকা উত্তরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু বার্তা২৪.কমকে বলেছিলেন, বিষয়টি বৈঠকের মতো না। অনেক প্রার্থী পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবকে পাচ্ছেন না। তারা এসেছিলেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। চেয়ারম্যান ঢাকায় এসেছেন, মহাসচিব ২৭ ডিসেম্বের ঢাকায় ফিরলে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
কতজন প্রার্থী এসেছিলেন আর নির্বাচনী এলাকায় ছেড়ে ঢাকায় অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে বলেন, ২২ জনের মতো প্রার্থী আমার অফিসে এসেছিলেন। আর তারা ঢাকায় অবস্থান করছে বিষয়টি এমন না। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো, তারা নির্বাচনী এলাকায় আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে।
দিন যত গড়াচ্ছে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। শনিবার তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে পার্টির পক্ষ থেকে কোনো ফান্ড দেওয়া সম্ভব না। এতে করে ক্ষোভে অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের অঞ্চলের ১৫ জন প্রার্থী সাংবাদিক সম্মেলন করে সরে যাওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। সিনিয়র নেতারা কথা বলে নিবৃত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রার্থী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তাদেরকে বলা হয়েছে নানা কারণে লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে পার্টির। সমঝোতায় সিনিয়র নেতাদের নাম না থাকা, পার্টির চেয়ারম্যানের স্ত্রী ঢাকা-১৮ আসন পাওয়া নিয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আবার রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া নিয়েও সংকট রয়েছে। এই অবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলে ব্যর্থতার দায়ভার তাদের কাঁধে চাপানোর সুযোগ তৈরি হবে।
নোয়াখালী জেলার একটি আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাই। অনেকবার চেষ্টা করেছি পার্টির চেয়ারম্যান সাক্ষাৎ দেননি। এমনকি বনানী অফিসে থাকলেও প্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দেননি চেয়ারম্যান। ২৬ জনের বিজয় নিশ্চিত করতে গিয়ে আমাদের বলি দেওয়া হয়েছে। এখন নিজের টাকা খরচ করবো কেন। এখন সরে গেলে অর্থ লোকসান থেকে বেঁচে যাব। মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত আমাদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল। নির্বাচন যাব কিনা সেই সিদ্ধান্ত ঝুলে রাখা হয়। এ কারণেও আমরা মাঠে পিছিয়ে পড়েছি।
ইতোমধ্যেই জাতীয় পার্টির ৩ জন প্রার্থী সাংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে প্রার্থী হলেও ঢাকায় বসে সময় পার করছেন। ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ-তাড়াশ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাকির হোসেন। জাতীয় পার্টির রায়গঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাঠে ছিলাম বেশ কয়েকটি নির্বাচনী অফিস করেছিলাম। নেতা-কর্মীদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার পর থেকে সব শেষ হয়ে গেছে।
১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে নাটকীয়তা। শেষ মুহূর্তে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয় জাপা। একই সময়ে আওয়ামী লীগ পৃথক সাংবাদিক সম্মেলন করে জাপাকে ২৬ আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিতেও সময়ক্ষেপণ করে দলটি। ইসি ১৫ নভেম্বর তফসিল দিলেও ১৯ নভেম্বর এসে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত জানায়।
জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দেওয়া ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো দিক নির্দেশনা দেয়নি দলীয় প্রার্থীদের। অন্যান্য নির্বাচনে পার্টি প্রধান কিংবা সিনিয়র নেতারা সফর করতেন। হাতে মাত্র কয়েকদিন সময় থাকলেও সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বাড়ছে। সমঝোতায় পাওয়া ২৬ আসনে তুলে আনাই ঝুঁকি দেখছেন অনেকে।