দিনভর বিক্ষোভ শেষে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে ফিরে গেলেন নেতারা। বিক্ষুব্ধ নেতারা আসতে শুরু করেছিলেন বেলা ১১টা থেকে আর ফিরে যান ৩টার দিকে।
তবে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এদিন অফিসে আসেননি। তারা দুপুরে সংসদে গিয়ে শপথ নেন, সেখান থেকে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যান। দুপুরে বনানী অফিসে যখন নজিববিহীন বিক্ষোভ হচ্ছিল তখন তারা ছিলেন সংসদ ভবনে।
চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগদেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান, বেশ কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতাসহ কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী। বাসে করেও লোক আনা হয় বিক্ষোভের জন্য।
তাদের পার্টি অফিসে আসার খবরটি আগেই জানাজানি হয়ে যায়, এমনও খবর রটে যায় বনানীস্থ পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় তারা দখল নিতে যাচ্ছেন। এ খবরে আগেই পার্টি অফিসের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। অফিস স্টাফ ছাড়া সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। বাড়ানো হয় পুলিশের নিরাপত্তা। পুলিশ সদস্যরা মুল ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পথ আগলে গেট বন্ধ করে দেয়।
বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম রুবেল, যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম শাহজাদা পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে মূল ফটকের ভেতরে প্রবেশ করেন।
তারা অফিসের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ সদস্যরা ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তখন প্রায় ৩০ মিনিট ব্যাপী উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে। এক পর্যায়ে সিনিয়র নেতারা বাইরে বের হয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। অফিসের বিপরীত দিকের ফুটপাতে চেয়ার নিয়ে বসে যান নেতারা। আর কর্মীরা রাস্তার উপরে অবস্থান নিয়ে নানা রকম স্লোগান দিতে থাকেন।
সেখানে এসে একে একে যোগদান করেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির, প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল হামিদ ভাসনী, সাংগঠনিক সম্পাদক বেলাল হোসেন, ছাত্র সমাজের সাবেক সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান মিরু, ছাত্র সমাজের সাবেক সভাপতি সৈয়দ ইফতেখার আহসান হাসান।
এসময় পার্টি অফিসের সামনে ভিড় সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশ তলব করা হয়। বেলা ১টার দিকে দাবি দাওয়া নিয়ে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের ব্রিফিং করা হয়। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা।
টেপা বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিলাম। এরমধ্যে তারা পদত্যাগ না করলে আমরা ধরে নেব তারা পদত্যাগ করেছেন। পাটি প্রার্থীদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা এবং তাদের এক প্রকার পথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য দুই শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়ে ২৬টি আসনে সমঝোতা করে সেখানেও ভরাডুবি হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, জাতীয় পার্টিকে এতটা বির্পযয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া এবং নির্বাচনে ভরাডুবির দায়িত্ব নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব পদত্যাগ করে তাদের সম্মান রক্ষা করবেন। কিন্তু সে বোধদয়ও তাদের হয়নি। আমরা পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোভাব জানতে পেরেছি। তারা পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে তাদের পদ থেকে অপসারণ দেখতে চান।
বেলা ৩টার পর থেকে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা একে একে এলাকা ছাড়েন। তারপরও অফিসের মূল ফটক বন্ধ করে রাখা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, জাতীয় পার্টির ইতিহাসে এমন বিক্ষোভ নজির বিহীন। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে আগে কখনও এমন বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেনি। গত নির্বাচনে পার্টির কোন ভূমিকা লক্ষ্যণীয় নয়।
তিনি বলেন, ভোটের সময় আমি নিজে দফায় দফায় ফোন দিলেও পার্টির চেয়ারম্যান রিসিভ করেননি। অনেক কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গে একই আচরণ করেছে। প্রার্থীদের কোন রকম সহযোগিতা করা হয়নি। তাদের ব্যর্থতার জন্য পার্টির এই ভরাডুবি। যে কারণে আমরা তাদের পদত্যাগ চাই।
এবারের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল জাতীয় পার্টির ভূমিকা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে দলটির অবস্থান ছিল রহস্যজনক। ইলেকশন কমিশন ১৫ নভেম্বর তফসিল দিলেও নির্বাচন প্রশ্নে পার্টির অবস্থান ঝুলে রাখা হয় ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। ২০ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি তখনও অন্ধকারে রাখা হয়।
মনোনয়ন ফরম বিক্রির দিনগুলোতে পার্টির পক্ষ থেকে বলা হতো নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখা হচ্ছে, জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা পরে জানানো হবে। অবশেষে ২২ নভেম্বর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানান দলটির মহাসচিব। ২৭ নভেম্বর ২৯৪ আসনে দলীয় প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। অন্যদিকে ছেলে সাদ এরশাদসহ অনুসারীদের আসন নিশ্চিত না হওয়ায় জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ২৯ নভেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
মনোনয়ন দাখিলের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে দলটির নেতারা। আসন ভাগা-ভাগি নিয়ে নানারকম গুজব ছড়তে থাকে। ওই দিনগুলোতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আবার ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দেয় দলটির নেতারা। রটে যায় নির্বাচন বর্জনের গুজব, বিষয়টি পার্টির পক্ষ থেকেও রহস্যবৃত্ত রাখা হয়। এ কারণে দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে ১৭ ডিসেম্বর (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার) পর্যন্ত। এতে করে অনেকেই নির্বাচনী দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়ে যান।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি। ওই আসনগুলো থেকে নৌকা সরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। ওই ঘোষণার পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন ২৬ আসনের বাইরে থাকা সাধারণ প্রার্থীরা। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক প্রার্থী পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলেন দলীয় ফান্ডের বিষয়ে। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ক্ষোভ হতাশা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ভোটের দিনেও অনেক প্রার্থী সরে দাঁড়ান। নির্বাচন পরিচালনায় পার্টির সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
নির্বাচন মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহিরও বিক্ষোভে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমরাও পার্টির চেয়ারম্যানকে ফোনে পাইনি। পার্টির মহাসচিবকে মাঠের অবস্থা অবগত করলে সমাধানের আশ্বাস দিলেও কোন কার্যকর উদ্যোগ নেননি।