সংগ্রাম, সাফল্য আর অর্জনে আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর

, রাজনীতি

রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-06-23 07:13:28

দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৮ সালে দেশ ভাগ হয়ে গঠন হয় পাকিস্তান। নতুন দেশে একক আধিপত্ত্ব মুসলিম লীগের। তবে সেখানে উপেক্ষিত ছিলেন সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থী) নেতারা। অন্যদিকে এক উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়েও মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হকের ফলাফল অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। পরে এই দুই দলের মিলনেই গঠন হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর।

মুসলিম লীগের এই উপেক্ষিত নেতারা ও মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হকের নেতৃত্বে আরেকটি দল তখন নতুন দল গঠনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মওলানা ভাসানী কে সভাপতি আর ইয়ার মোহাম্মদ খান কে সাধারণ সম্পাদক করে একটি সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটি করা হয়। তারা একটি সভা ডাকেন কিন্তু সভা করার জন্য কোনো অডিটরিয়াম পাচ্ছিলেন না।

পরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান। সেদিন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলের নাম প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নাম রাখা হয় 'নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'।

সেখানে সে নতুন দলের জন্য ৪০ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে প্রথম কমিটির সভাপতি হন মওলানা ভাসানী। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান।

সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান, যার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে প্রথম সভার আয়োজন হয়। তখন শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

অপরদিকে ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর সভাপতি করা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী -কে।

সেদিন শুরু হওয়া সে দলটি নানা সংকটাকীকির্ণ পথ চলতে চলতে আজ ৭৫ বছরে পা রেখেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। সাম্প্রদায়িকতা থেকে বের হয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়।

দেশের অন্যতম পুরনো, অসাম্প্রদায়িক, সর্ববৃহৎ ও বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই শুরু হয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রথম কাজ। যার নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ তথা সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সবখানেই যে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে সেটি আওয়ামী লীগ। এছাড়াও ১৯৫৪ সালের আইয়ুবের সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, ’৬৪-এর দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সবখানেই ছিলো দলটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। যার নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ধাক্কা খায় আওয়ামী লীগ। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা কাটিয়ে উঠে দীর্ঘ একুশ বছর লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে দলটি। যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অপশাসন, দমন পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ ‘দিন বদলের সনদ’ঘোষণা দিয়ে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে পুনরায় বিজয় অর্জন করে এবং সেই থেকে টানা ৪ বার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে।

গত ১৫ বছরে দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নের সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা এবং রায়ও কার্যকর করা, সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ করার মত বিভিন্ন সফল উদ্যোগ নেয় দলটি।

এসব কিছুই করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর গত ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে সফলভাবে এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তার নেতৃত্বেই দলের নেতাকর্মীরা পেয়েছেন উৎসাহ-উদ্দীপনা। সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়েছে সমৃদ্ধ। স্বৈরতন্ত্রের চৌহদ্দি পেরিয়ে গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে বাংলার জনগণ। কালের বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বাপ্নিক অভিযাত্রী বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। তার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছে ‘ভাত ও ভোটের অধিকার। শুরু হয় গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা। সুশাসন, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, উন্নয়নে গতিশীলতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে করেছেন যুগান্তকারী উন্নয়ন। বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগ তার জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত জনগণকে তার শক্তির উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংগঠনের শক্তির উৎস করেছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। তাই আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ও সংগ্রামের ইতিহাস।

আওয়ামী লীগের ২৩ জুন ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী (প্লাটিনাম জয়ন্তী) উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যারমধ্যে রয়েছে, রোববার (২৩ জুন) সূর্য উদয় ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন।

সকাল ৭ টায় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরস্থ ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সমাধিতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন: সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি, সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খান এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী এমপি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন্নাহার এমপি, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা এমপি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য সাহাবুদ্দিন ফরাজী প্রমুখ।

এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। এরপর দুপুর ২ টা ৩০মিনিটে আলোচনা সভা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করনে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন উপযোগী কর্মসূচির মাধ্যমে জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের জেলা/মহানগর, উপজেলা/থানা, পৌর/ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড শাখাসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মী সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর