সবকিছু ঠিক থাকলে আজই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণা করা হতে পারে। যদিও এবারই এমন ঘটনা প্রথম নয়। এর আগে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ অভিযোগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামী দলটি বাংলদেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত-সমালোচিত দল। কোন রাজনৈতিক দল দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও পরবর্তীতে সে দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকার উদাহরণ বেশ বিরল ঘটনা হলেও এই দলটির জন্য তা কিছুটা ব্যতিক্রম।
এই দলটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
তবে এই দলটির গোড়াপত্তন হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলেই।
এই প্রতিবেদনে জামায়াত ইসলামী দলের ইতিহাস তুলে ধরা হলো-
ব্রিটিশ ভারত (১৯৪১-১৯৪৭)
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। জামায়াত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দল মুসলিম লীগকে সমর্থন করেনি।
স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান। বর্তমান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় পার্টির অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
পাকিস্তান সময়কাল (১৯৪৮-১৯৭১)
পাকিস্তান সৃষ্টির পর জামায়াতে ইসলামী মূলত ভারত ও পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের শাখা থেকে সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণিত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মওদুদী সহ ৬০ জন জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম তাদের একজন। ঐ বছর অক্টোবরেই আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
জামায়াতে ইসলামী, জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন ঘোষণার সময় পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং ১৯৬৫ সালে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ছয় দফা এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত ১১ দফার তারা তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ টি আসন লাভ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর।
১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
বাংলাদেশ অধ্যায় (১৯৭১-বর্তমান)
১৯৭১ সালের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত ও এর আওতায় পড়ে। ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সকল ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দলের সাথে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত ছিল। পরে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গঠিত হয়। এসময় এর ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ লাভ করেন আব্বাস আলী খান। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এটি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮টি আসন লাভ করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম শরিক হিসেবে সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করে। এরপর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এটি ৩০০ আসনের মধ্যে ২টি আসন লাভ করে।
জাতীয় সংসদে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ
১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতের কিছু নেতা ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ৬ জন প্রার্থী জয়ী হন। ১৯৭৯ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে এ দলটি পুনরায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় এবং মওলানা আব্বাস আলী খানকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমীর নির্বাচন করা হয়।
১৯৭৯ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসনে জয়লাভ করে। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে জামায়াতের ১০ জন সংসদ সদস্য ১৯৮৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থীরা ৩৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮টি আসনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠনের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সমর্থন দেয়। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০টি আসনের মধ্যে জামায়াত ২টি আসন লাভ করে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎভাবে আন্দোলন করে স্বার্থক হয়। এবং নির্বাচন করে তিনটি সংসদীয় আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে তারা ছিলেন চতুর্থ অবস্থানে।
২০০১ সালের অষ্টম জতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে অংশগ্রহণ করে ১৭টি সংসদীয় আসন লাভ করে এবং মন্ত্রী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দু'জন সদস্য মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করে দুইটি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে ভোট অনুযায়ী তারা চতুর্থ এবং আসন অনুযায়ী পঞ্চম অবস্থানে ছিলো।
নিবন্ধন বাতিল
কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের ২৫ জন সদস্য জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলে আদালতের বেঞ্চ। পরবর্তিতে ১ আগস্ট ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রুলের রায় ঘোষণা করে এতে সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং সংগঠনটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।