আম্পায়ারিংয়ের ঘরোয়া কেলেঙ্কারির আর্ন্তজাতিক উন্মোচন!

ক্রিকেট, খেলা

এম.এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪,কম | 2023-08-27 07:30:19

ঘরোয়া ক্রিকেটে পক্ষপাতমুলক আম্পায়ারিং, পাতানো ম্যাচের কেলেঙ্কারি প্রায় সময়ে চাপা পড়ে যায়। দেশের পত্রপত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া, টিভি চ্যানেল এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে জোর প্রতিবাদ এবং সত্য উন্মোচনে বড় ভুমিকা রাখে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের এতসব কেলেঙ্কারি আর্ন্তজাতিক নজর সবসময় পায় না। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে দেশি আম্পায়ারদের চরম কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ঘরোয়া ক্রিকেটের কেলেঙ্কারিকে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বেমালুমভাবে ফাঁস করে দিলো।

লেগসাইডে ছয়জন ফিল্ডার রাখার ভুল। সাকিব কট বিহাইন্ড হলেন, কিন্তু আম্পায়ার নির্দেশ দিলেন ওয়াইড বল; আরেকটি ভুল। এভিন লুইসের একহাত সামনে ব্যাটে বল লাগলো, আম্পায়ার বললেন এলবিডডব্লু; ভুল! পপিংক্রিজের দাগের ভেতরে পা, আম্পায়ার জানালেন নো বল। এক ওভারে টানা দুই বলেই একই ঘটনা। দু’বারই রিপ্লেতে পরিস্কার-ওটা নো বল নয়। আট মিনিট খেলা বন্ধ। খেলা শুরুর জন্য ম্যাচ রেফারিকে মাঠে নামতে হয়। এহেন কেলেঙ্কারির দায়ভার পুরোটাই দেশি আম্পায়ারদের। সুনির্দিষ্ট করে নামটা বললে আম্পায়ার তানভীর আহমেদ এবং গাজী সোহেলের। দুজনেই এই সিরিজে এমন হাস্যকর কিছু ভুল করেছেন যা তাদের আম্পায়ারিংয়ের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভুল ও নির্দেশিত এবং পক্ষপাতমুলক আম্পায়ারিং কেলেঙ্কারির ঝুঁড়ির ময়লা এখন আর্ন্তজাতিক পরিসরেও উন্মোচিত হয়ে গেল। 

আম্পায়ারিংয়ে ভুল, নতুন কোন ঘটনা নয়। তবে সেই আম্পায়ারিং যখন যোগ্যতার প্রশ্নের মুখে পড়ে, সন্দেহের পথ তৈরি করে, তখন সেটা অবশ্যই বড় ঘাটতি। পরিস্কার ভাষায় যাকে বলে-দায়িত্বহীন আম্পায়ারিং। এই আম্পায়াররা ঘরোয়া ক্রিকেটে সারাজীবন আম্পায়ারিংয়ে প্রচুর ভুল করেছেন। ইচ্ছেকৃতভাবে নো বল, ওয়াইড বল কল করে গেছে। কর্তার ইচ্ছেয় কর্মসাধন করেছেন। তেমনভাবে কখনোই তাদের এমনসব ভুলের কোন হিসেব-নিকেষই নেয়া হয়নি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে এই আম্পায়াররা সেটাই করেছেন। বিভিন্ন ক্লাবের বড় কর্মকর্তা এবং বোর্ডের দায়িত্বে থাকাদের কাছ থেকে প্রশয় পেয়েই এই আম্পায়াররা তাদের ভুল সিদ্ধান্তকেই ‘সঠিক’ বলে চালিয়ে দেয়াকে কুঅভ্যাস বানিয়ে ফেলেন!

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের শেষ ম্যাচে আম্পায়ার তানভীর আহমেদের যোগ্যতার প্রশ্ন আসছে এই কারণে যে, একটা ভুল করার পর ঠিকই পরের ভুলেই সেই একই ভুল তিনি করেছেন! যদিও প্রথম ভুলের পরই তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে তিনি বড় ভুল করেছেন। কিন্তু সেটা থেকে মোটেও কোন শিক্ষা নিতে পারেননি তানভীর। পরের বলেই আবার সেই আগের ভুল করলেন। অর্থাৎ তিনি তো শিখলেনই না! ভুল থেকে যিনি শিখতে পারেন না, উল্টো একের পর এক ভুল করেই যান; তার যোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই।

ঘরোয়া ক্রিকেটে কর্তার ইচ্ছেয় আঙ্গুল তুলে দেয়ার অভ্যাসের দাস হয়ে যাওয়া এমনসব আম্পায়াররা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটেও দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। মাঠে হাস্যকর ভুলগুলো সেই দাসত্বেরই দাগ!

১৮ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। অথচ দেশের আম্পায়ারিং সেক্টর সবচেয়ে অবহেলা এবং যেনতেন ভাবে চলছে। সেই ভিক্টোরিয়ান আমল থেকেই যিনি আম্পায়ারিং বোর্ড বা পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন, সেই তিনিই এখন পর্যন্ত চেয়ারের পেছনে তোয়ালে ঝুলিয়ে বসে থাকেন! এতই মধু এখানে যে নতুন কাউকে জায়গা দিতেই নারাজ আম্পায়ারিং কমিটির পন্ডিতরাজরা!
যার ফলাফল এখনো আইসিসি’র এলিট প্যানেলে কোন বাংলাদেশী আম্পায়ারের জায়গাই হয়নি! অথচ জিম্বাবুয়েরও আর্ন্তজাতিক ম্যাচ রেফারি আছে! আর্ন্তজাতিক আম্পায়ারিংয়ে বাংলাদেশের মর্যাদার ক্রমমান শূণ্যের কোটায়।

-দায়টা কার?

সার্বিক অর্থে দায়টা ক্রিকেট বোর্ডের। একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেট শুধুমাত্র জাতীয় দল দিয়ে হয় না। শুধুমাত্র জাতীয় দলের দিকে সব মনোযোগ ঢেলে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে সামনে বাড়লে সেই দেশের পরিণতি কেনিয়ার মতো হতে বাধ্য।

ব্যাখাটা এমন। বাংলাদেশ আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এমন ভাল ফল করছে তার মুল কারণ আমাদের এই জেনারেশন কয়েকজন তুমুল প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী ক্রিকেটার পেয়েছে। জাতীয় দলের সাফল্যের সিংহভাগই আসছে তাদের পারফরমেন্সের কল্যানে। কেউ যদি মনে করেন এটাই সাফল্য গল্পের সবকিছু, তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

দেশকে সাফল্য এনে দেয়া এই চার-পাঁচজন ক্রিকেটার তো অনন্তকাল ক্রিকেট খেলবেন না। বা দেশকে সেবা দিতে পারবেন না। তাই আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের পরিমন্ডলে যদি এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে। শরীরের কোন একটা অংশ যদি হঠাৎ করে বড় হয়ে যায় তখন সেটাকে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং তখন দুঃশ্চিন্তা ছড়ায়। একটা উদাহরণ দেই। চারদিকে সমানভাবে বৃদ্ধি না হয়ে যদি দেখা গেলো শরীরের হাতটা শুধু বিশাল লম্বা হয়ে গেছে, অথবা পা লম্বা হয়ে গেছে। বাকি অংশ শুকনো খটখটে! তখন সেই বৃদ্ধিকে কি কেউ স্বাভাবিক বলবেন? বরং বলবেন-বিঁধঘুটে! দেশের ক্রিকেটের অবস্থা এখন সেই পর্যায়ে পৌছে গেছে। জাতীয় দল ভাল করছে। সাফল্য পাচ্ছে। স্বর্নালি কিছু প্রজন্মের কৃতিত্বে সাফল্য আসছে। সেটা দেখে কর্তারা বুক ফুলিয়ে বলছেন-আহা কি সুন্দর! বাহবা কি চমৎকার! জাতীয় দল হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের চেহারা। সাফল্যের চর্বিতে সেই চেহারা এখন ঝলমলো চিকনাই। কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশে যে অযোগ্যতা ও অনিয়মের ভাইরাস জটিল রোগশোক বাঁধিয়ে দিচ্ছে। সেই ভাইরাসের অন্যতম নাম ঘরোয়া ক্রিকেটের পক্ষপাতমুলক আম্পায়ারিং।

ঘরোয়া ক্রিকেটের দুনম্বরি আম্পায়ারিংকে গা সওয়া অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন ক্রিকেট কর্তারা। প্রত্যক্ষভাবেই তারা আম্পায়ারিংয়ের চুরি-চামারিকে প্রশয় দিয়েছেন। মাঠের আম্পায়ারকে দুনম্বরি করতে নির্দেশটা তো তারাই দিচ্ছেন। এসব নিয়ে যে মিডিয়ায় রিপোর্ট হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর দুদিন খানিকটা চেঁচামেচি হয়, তৃতীয়দিন সেটা ধামাচাপা। সবকিছু ভুলে যাওয়া।

উদারহণ তো হাতের কাছেই!

কিছুদিন আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের শেষ ওভারে যে ঘটনা ঘটলো সেটা কোনমতেই ক্রিকেট না। সেটা ক্রিকেটকে গলাটিপে খুন করার সামিল! ফতুল্লার মাঠে ম্যাচ জিততে শেষ ওভারে অগ্রণী ব্যাংকের প্রয়োজন ৪ রান। হাতে জমা ৩ উইকেট। ৫২ রান নিয়ে ব্যাট করছেন দলের ব্যাটসম্যান তৌহিদ তারেক। শেষ ওভার শুরুর আগে তৌহিদকে বাউন্ডারি লাইনে ডেকে নিলেন অগ্রণী ব্যাংকের ক্রিকেট কর্মকর্তা। বললেন-ম্যাচটা ছেড়ে দিতে হবে। তৌহিদ রাজী হলেন না। মাঠে ফিরে আম্পায়ারকে তৌহিদ বললেন-তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। ব্যাট করতে পারবেন না। রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়লেন তৌহিদ। তার জায়গায় ব্যাট করতে নামলেন শহিদুল ইসলাম। ছয় বলে জিততে চাই ৪ রান। সহজ টার্গেট। কিন্তু শহিদুল সেই ওভারের সবকটি বল বøক করলেন। মেডেন দিলেন! রান নেয়ার কোন চেষ্টাই করলেন না! প্রতিপক্ষ ওল্ডডিওএইচএস ৩ রানে ম্যাচ জিতলো।

এটাকে কি আপনি ক্রিকেট খেলা বলবেন? পরিস্কার দৃষ্টিতে এটা প্রতারণা। জোচ্চুরি। ইচ্ছে করে ম্যাচ হারা। পাতানো ম্যাচ। এত বড় অপরাধের ঘটনা ঘটলো। পত্রিকায় ফলাও করে রিপোর্ট হলো। অথচ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে টুঁ শব্দ নেই।

কারণ ক্লাব কর্তারাই যে বোর্ডের বড় চেয়ারে আসীন!

এ সম্পর্কিত আরও খবর