পঞ্চপাণ্ডবের দিন শেষ, ধন্যবাদ বলার সময় এলো তাহলে?

ক্রিকেট, খেলা

এম. এম. কায়সার | 2023-11-27 18:00:50

তারা পাঁচ। তাদের ভালোবেসে ডাকা হতো ‘পঞ্চপান্ডব’ নামে। পাঁচজনই অভিজ্ঞ। ম্যাচউইনার। দারুণ বন্ধুত্ব ছিল তাদের।

-ছিল?

হ্যাঁ, এই সম্পর্কে সুসম্পর্ক শব্দটা এখন অতীত। এই সৌহার্দ্যে জট-জটিলতার ধারালো কুড়াল সবার আগে মেরেছেন সাকিব আল হাসান। আর তাই বাকি পাণ্ডবদের এক-দুইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের রেখাচিত্র সবচেয়ে বেশি নিম্নমুখী। তামিমের সঙ্গে সাকিব কথা বলেন না। বন্ধুত্ব তো দূরের কথা। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগের এক সাক্ষাৎকারে সাকিব যেভাবে প্রকাশ্যে তামিমের সমালোচনা করেছেন তাতে তাদের সম্পর্কের ময়লা ঢাকার দূষিত বাতাসের চেয়েও চরম অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে! বিশ্বকাপের ঠিক আগেভাগে তামিম-সাকিব দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, বিবাদ, একে অন্যকে অপদস্ত ও ঘায়েল করার ‘কুৎসিত ম্যাচ’ দেখেছিলো গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।

এই পাঁচ পান্ডবদের মধ্যে প্রথম কে আর দ্বিতীয় কে-তার একটা নিজস্ব সমাধান দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। পুরোদস্তুর ঘোষণার ভঙ্গিতে সাকিবের দাবি, প্রথমে আমি তারপর অন্য পান্ডব! অর্থাৎ মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ, তামিম ইকবাল ও মুশফিকের চেয়ে নিজের নামটাই এই তালিকায় প্রথমে রেখেছেন সাকিব। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের তুল্যমূল্য বিচারে আনলে সাকিবের এই দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সব অনুষ্ঠানে সামনের চেয়ারে না বসলে মর্যাদা থাকে না-এমন মানসিকতা শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত দেয় না; বরং তা সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্স বা গরিমার প্রকাশমাত্র!

মাশরাফি জাতীয় দলে এখন আর নেই। তাই পঞ্চপাণ্ডবের এই লড়াইয়ের রিং থেকে অনেক দূরেতিনি। মাঝে মাঝে বিবেক বা বিচারকের ভঙ্গিতে ফেইসবুকে সব পক্ষকে এক চৌকাঠে রাখার জন্য স্বস্তিদায়ক কথাবার্তা বলেন। বিপদ বড় হলে বিসিবিও তাকে মাঝে সাজে বৈঠকে ডাকে। মাশরাফি এসে শালিসি সভায় মিলমিশ করানোর একটা চেষ্টা চালান। মাঠের বাইরের ক্রিকেট জটিলতা মেটাতে আপাতত সাবেক অধিনায়কের কাজের পরিধি অতটুকুই। জাতীয় দলের জার্সি যে মাশরাফির গায়ে আর উঠছে না, সেটা পরিস্কার। তবে যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো তিনি আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেননি, তাই তার নামের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সাবেক ক্রিকেটার’ বসানোর উপায়ও নেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে মাশরাফি এখন কোনো স্তরেই জাতীয় দলের পরিকল্পনায় আর নেই। জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি ২০২০ সালের মার্চে।

তাকে সেই তখনই ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে দিয়েছে বিসিবি।

মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় তারা এখনো একে অন্যের বাসায় দাওয়াত কবুল করেন। দুজনের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। এই দুই পাণ্ডবের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজমান।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ শুধুমাত্র ওয়ানডে ফরমেটে খেলেন। এক অর্থে অভিমান করেই টেস্ট থেকে তিনি স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। টি- টোয়েন্টির বিবেচনায় তাকে রাখেনি দল। ওয়ানডেতেও তিনি বাদের তালিকায় ছিলেন। ২০২৩ সালের বিশ্বকাপের প্রাথমিক পরিকল্পনা তার নামই ছিল না। তাই নির্বাচকরা তাকে বিশ্বকাপের আগে লম্বা সময়ে বিশ্রামে রেখেছিলেন। মুলত বিশ্রামের আড়ালে তাকেই বাদই দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বকাপের দলে তার কোনো বিকল্প না পাওয়ায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ১৫ জনের দলে রাখা হয়। আর পুরো বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যে ক্রিকেট খেললেন তাতে নির্বাচকরা এখন পরের ওয়ানডে সিরিজের জন্য তার নামটাই লিখবেন সবার আগে! তবে সমস্যা হলো বয়স জানাচ্ছে মাহমুদউল্লাহর সামনের সময়ের ক্রিকেট খুবই সংক্ষিপ্ত। নিশ্চয়ই চারবছর পরের বিশ্বকাপের একাদশে পরিকল্পনায় মাহমুদউল্লাহ থাকছেন না। টেস্ট এবং টি- টোয়েন্টির বিদায়ে তাকে কোনো বিদায়ী মানপত্র দিতে পারেনি বিসিবি। সেই দুঃখ কাটিয়ে উঠার সুযোগ এসেছে ক্রিকেট বোর্ডের সামনে। মাহমুদউল্লাহও নিশ্চয়ই জানেন সরিয়ে দেওয়ার আগে সময় থাকতেই সরে যাওয়াটা বেশি মর্যাদার।

পাঁচ পাণ্ডবের মধ্যে মুশফিকুর রহিম সবচেয়ে ফিট। টি- টোয়েন্টিকে বিদায় জানিয়েছেন বছর কয়েক আগে। ওয়ানডে এবং টেস্ট খেলেন শুধু। টেস্টে শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে একাদশে জায়গা তার। ওয়ানডেতে এখনো গ্লাভস হাতে কিপিংয়ের বাড়তি দায়িত্বও সামাল দেন। তার জন্য বিদায় মঞ্চ সাজাতে বিসিবি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় থাকতে সম্মত। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে জাতীয় দলে সম্ভবত মুশফিকের ক্যারিয়ারই সবচেয়ে দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনার রেখাচিত্র একটু বেশিই স্পষ্ঠ।

গেল একটা বছর ধরে তামিম ইকবাল মাঠের ক্রিকেটের চেয়ে মাঠের বাইরের ঘটনা-দুর্ঘটনা, তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমান, রাগ-আবেগ নিয়েই বেশি আলোচিত। এই সময়টায় ক্রিকেট ছেড়েছেন। আবার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ক্রিকেটে ফিরেছেন। অধিনায়ক ছিলেন। অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন। বিশ্বকাপের পরিকল্পনায় ছিলেন। বাদ পড়েছেন। একসময়ের বন্ধু সাকিবের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক শত্রুতা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বাজে শিরোনাম! পিঠের চোট তার কবে সারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মাঠের ক্রিকেটে আবার বাংলাদেশ তাকে কবে পাবে, তা তিনি এবং বিসিবি কেউ জানে না। কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। জাতীয় দলে খেলার জন্য যে তাগিদ, যে অনুভব, যে জোরদার ইচ্ছাশক্তির কথা আমরা শুনে থাকি, সেই আবশ্যিক শর্তগুলো পূরণে সাম্প্রতিক সময়ে তামিম ইকবালও কি জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছেন? বিশ্বকাপে খেলার জন্য তামিম যেভাবে মরিয়া আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এখন জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট বা ওয়ানডে সিরিজ খেলার জন্য সেই তাড়নায় যে বড্ড বেশি ঘাটতি এই ওপেনারের মেজাজ-মর্জি ও ইচ্ছেয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে নিজের শেষের শুরু দেখে ফেলেছেন তামিম ইকবাল। তার জন্যও এবার বিদায়ী ক্রেষ্ট তৈরি করতেই পারে বিসিবি!

সাকিব আল হাসান যা করেন মোটামুটি ঘোষণা দিয়েই করেন। বিশ্বকাপের আগে বলেছিলেন এই টুর্নামেন্টই তার অধিনায়কত্বের শেষ। ২০২৫ এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলে ওয়ানডে ক্রিকেটও ছেড়ে দেবেন। নিঃসন্দেহে সাকিব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে খেলা সবচেয়ে প্রভাবী ক্রিকেটার। তিনি বিসিবির ইচ্ছেমাফিক নয়, বরং বিসিবিই চলে তার ইচ্ছে ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক। বিশ্বকাপ শেষে আরেকটি চমক দেখান সাকিব। জাতীয় নির্বাচনে নেমে পড়েন। এবার এমপি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তার। খেলার মাঠে থেকেই রাজনীতির মঞ্চে হাজির সাকিব। খেলা এবং রাজনীতি দুটোই চালিয়ে যেতে চান। পরিবার থাকে বিদেশে। খেলার ফাঁকে সময় পেলেই যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে ছুটতে হয় তাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও ব্যস্ত রয়েছে। হর-হামেশা শো-রুম উদ্বোধনের সূচিও তাকে পালন করতে হয়। সবমিলিয়ে ক্রিকেটের সাকিব এখন ক্রিকেটে কম, অন্যত্র বেশি।

বিসিবি’র উচিত তাকে ক্রিকেট ব্যস্ততা থেকে মুক্ত করে দেওয়া।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপের সময় থেকে এই পঞ্চপান্ডব শব্দের আবি ভাব। যদিও এই পাঁচজনে এর আগে থেকেই জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলেছেন। কিন্তু মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ও পরবর্তী কয়েক বছরের দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সাফল্যে এই পাঁচের কৃতিত্বই ছিল বেশি। সে সময়কার প্রায় সবগুলো বড় জয়ে এই পঞ্চপাণ্ডবের কোনো না কোনো একজনের ভূমিকা ছিল মূখ্য। এই পাঁচজনকে এক ফ্রেমে রেখে তাদের ছবি তোলাটা ছিল ক্রিকেট ফটোগ্রাফারদের জন্য আরাধ্য বিষয়।
সেই ফটো ফ্রেম ভেঙ্গে গেছে। এই পাঁচজনের সবাইকে আর কখনোই এক দলে তো নয়ই, এক ছবির ফ্রেমেও সম্ভবত পাওয়া যাবে না!
বিসিবির উচিত সামনে তাকিয়ে একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া।

-এম. এম. কায়সার, সম্পাদক- স্পোর্টস বাংলা

এ সম্পর্কিত আরও খবর