-ওই যে দুর্গ দেখছেন, ওটার নিচের দিকেই একটা গেস্ট হাউস। ওখানেই থাকছি আমি। ঘুরে আসতে পারেন, ভালো লাগবে।’
ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম প্রেসবক্সে বসে গলে তার ঠিকানা জানাচ্ছিলেন। গল স্টেডিয়ামের প্রেসবক্স থেকে নজর দিতেই মাঠের ভেতরের চেয়ে বাইরেই চোখ আটকে গেল আগে!
মাঠের সাইট স্ক্রিনের ঠিক পেছনেই বিখ্যাত গল দুর্গ চোখের সামনে। দুর্গের বেশিরভাগ অংশই ছোপ ছোপ কালো। কিছুটা আবার শ্যাওলা ধরা। পাথরের ছোট-বড় চাঁই স্তর করে রাখা। তাতেই তৈরি কালো-শ্যাওলা ধরা বিশালাকায় প্রাচীর। মজার বিষয়টা হলো শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ দেখতে মাঠের দর্শকের চেয়ে সেই দুর্গের চাতালেই বেশি লোক চোখে পড়ল! মাঠের চারধারের গ্যালারি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। সুউচ্চ দুর্গের বিশাল প্রাচীরের ধার ঘেঁষে বসে কেউ। কেউ ঘাসে বসে পা দোলাচ্ছেন। সেই উচ্চতা থেকে মাঠের ক্রিকেটের আনন্দ নিচ্ছেন। দূরত্ব এবং উচ্চতা বলছে, প্রাচীরের অত উঁচু থেকে মাঠের ক্রিকেটারদের তো একেবারে লিলিপুটের মতো দেখানোর কথা!
শ্রীলঙ্কার গলে বেড়াতে এসেছেন আর গল দুর্গে যাননি? সম্ভবত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সফরের ডায়েরিতে তাই ডু এবং ডোন্ট এর পরিকল্পনার পাতায় লিখে রেখেছিলাম- টেস্ট ম্যাচের ফাঁকে ঐতিহাসিক গল ফোর্টে একবার ঢুঁ মারতেই হবে।
টেস্টের প্রথম দিনের লাঞ্চ বিরতিতে প্রেসবক্স থেকে বেরিয়ে এলাম। গল স্টেডিয়াম চত্বরেই টুকটুক (ট্যাক্সি) মিলল। গল ফোর্টের ভেতরে টুকটুক থেকে নামতেই মনে হলো সামান্য এই পথ তো হেঁটেই আসা যেত!
কিন্তু সমুদ্রের এই শহরে রোদের যে তীব্রতা! মিনিট কয়েক সেই রোদ মাথায় নিলে কপাল ঝিমঝিম করবে। ফোর্টে পর্যটকে গিজগিজ। প্রায় সবার হাতে ক্যামেরা। ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাসের সঙ্গে নিজের স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টায় সারাক্ষণই কানে লাগল ক্যামেরার সাটারের শব্দ। সেলফোনে সেলফি তখনো তেমন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেনি!
গল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্স থেকে ফোর্টের একপাশের অংশ দেখা যায়। রাস্তার ওপারে থাকা বিখ্যাত ফোর্ট ক্লক তো এই ক্রিকেট মাঠের সৌন্দর্যই বদলে দিয়েছে। ফোর্টের সুুউচ্চ প্রাচীরে বসে মাঠের ক্রিকেট উপভোগ করাদের তালিকায় আতহার আলী খানকেও পেয়ে গেলাম। ফোর্টের সবুজ ঘাসের ছাদে বসে বাদাম খাচ্ছেন, খেলা দেখছেন। ধারাভাষ্য ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য এখানে এখন আতহার আলীও পর্যটক।
বাইরে থেকে দেখে ভেবেছিলাম ফোর্টের ভেতরে শুধু সবুজ ঘাসে বেড়ানোর জায়গা আর রেস্টুরেন্ট, চা-কফির দোকান-টোকান হবে। কিন্তু বিশাল সুড়ঙ্গের মতো প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ফোর্টের চারধারে ঘুরে ভুলটা ভেঙ্গে গেল।
এই দুর্গের জন্মকথা জানাল, ষোলশ শতকে পর্তুগিজরা গল দুর্গ বানায়। দুশো বছর পরে এই দ্বীপ রাজ্য দখল করে ডাচরা দুর্গটা আরো শক্তপোক্ত করে। ব্রিটিশ শাসনের সময় পুরো দুর্গ এলাকা আরও উন্নত হয়। সেই থেকেই গল ফোর্ট এই দ্বীপ দেশটির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপিয়ান স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের সৌন্দর্য কত আর্কষণীয় হতে পারে- তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই গল ফোর্ট।
-কী নেই এখানে?
ব্যাংক, স্কুল, আদালত, গেস্ট হাউস, ক্যাফে, জাদুঘর, মসজিদ, চার্চ, লাইট হাউস, সেনাবাহিনীর ব্যারাক- সবকিছুই। গল প্রাচীরের চূড়ায় উঠলে পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে যতদূর দৃষ্টি যায়- শুধু সাগর আর সাগর। ভারত মহাসাগরের নীল-সাদা ফেনিল ঢেউ।
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কয়েকজনের দেখাও মিলল প্রাচীরের এই অংশে। কয়েকশ ফুট উচু সেই প্রাচীরের ওপর থেকে নিচের উত্তাল সমুদ্রে ডাইভ দিচ্ছেন অতি সাহসী কয়েকজন!
২০০৫ সালের ডিসেম্বরের সুনামিতে গল স্টেডিয়াম ভেঙ্গে চুরে একাকার হয়ে যায়, কিন্তু ফোর্টের প্রাচীরের একটা পাথরও টলেনি। শুধু নিচের কিছু অংশ পানিতে প্লাবিত হয়। তৈরির দিন থেকেই এই দুর্গ ও প্রাচীরের সুরক্ষা ব্যবস্থা এমন নিখুঁত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে, যা শুধু মানুষ নয়; প্রকৃতির সঙ্গেও লড়াই জেতার শক্তিও রাখে!
ইতিহাস জানাচ্ছে- ষোড়শ শতাব্দীতে এই দ্বীপ রাজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল গল। সে সময় সমুদ্র অঞ্চলে নিজেদের দাপট-দখল ও বহিঃশত্রু এবং জলদস্যুদের হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য দ্বীপটির তীর ঘেষে এই বিশাল প্রাচীর তৈরি করেছিল পর্তুগিজরা। পরে গলে ডাচরা এসে কর্তৃত্ব করার পর নিরাপত্তা ব্যূহ আরও জোরদার হয়। হাতে টানা কামান বসানোর জন্য প্রাচীরের কোনাকুনি অংশ ঘিরে অনেকগুলো খাঁজ বা পরিখা বানায় তারা। বাঙ্কারের আদলে সেই খাঁজে অস্ত্রটস্ত্র জমা রেখে শত্রুর মোকাবেলার জন্য পুরো প্রাচীর এলাকাকে একেবারে যুদ্ধের সাজে সাজানো হয়। গল ফোর্টের উঁচু এইসব খাঁজে হাত বুলিয়ে চারশ বছর পুরনো ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার আনন্দ-রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেল শরীর মন জুড়ে!
গ্ল্যাডিয়েটরস, জলদস্যু, অশ্বারোহী যোদ্ধা, লং লিভ দি কিং- ফোর্টের সবুজ ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে শব্দগুলো মস্তিষ্কের কোষে ধাক্কা দিচ্ছিল।
গলে ক্রিকেট কাভার করতে এসে এই দুর্গে না এলে ইতিহাস আনন্দের অনেক কিছু মিস হয়ে যেত!
থ্যাঙ্ক ইউ, মোহাম্মদ ইসাম!
আগামীকাল থাকছে: মার্টিন বিক্রেমাসিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ