মেঘ মেদুর বরষায়-নজরুলগীতি রেকর্ড হবার পর দীপালি নাগের খ্যাতি গানের জগতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি গানের জগতে রাতারাতি স্টার-এ পরিণত হন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আগ্রা ঘরানার বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি অর্জন করেছিলেন তিনি। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের কাছে শিখেছিলেন খেয়াল, ঠুঙরি, ভজন। সেকালে রেডিওর নব ঘোরালেই শোনা যেত দীপালি নাগের গান, যিনি স্পর্শ করেছেন শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক। দীপালি নাগের গৃহে ছিল সঙ্গীত চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। বাড়ির অনেকেই গানবাজনা করতেন। পিতা কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে আগ্রায় থাকতেন।
দক্ষিণ কলকাতার 'শরৎ সমিতি' শরৎচন্দ্রের বাসভবনে আয়োজন করে বিদূষী দীপালি নাগের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এক মহতী স্মৃতিচারণ সভা। ২২.০২.২০২২. শুরু হয় এই গুণী সঙ্গীত শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা। নজরুল জীবন- সাহিত্য - সঙ্গীত চর্চার প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের কান্ডারী সোমঋতা মল্লিককে একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেখা গেল।
এদিনের সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন কাকলী সেন, দীপালি নাগ যাঁর গুরুমা ছিলেন। এই সভায় তাঁর একটি সিডি তিনি শরৎ সমিতির সম্পাদক ড. শ্যামল কুমার বসুর হাতে তুলে দেন। এতে নজরুল গীতি তিনি গেয়েছেন শ্রীমতি দীপালি নাগের নির্দেশনায়, পুরোনো দিনের গানের স্টাইল ও বৈভব বজায় রেখে। তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত সাধিকাকে, যিনি জীবনে অকৃপণ ভাবে পেয়েছিলেন শ্রোতার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
দীপালি নাগ ছিলেন স্নেহময়ী গুরুমা, জীবনে সঠিক পথে চলার পরামর্শদাতা। বাড়িতে অতিথি এলে নিজের হাতে লুচি ও আলুরদম তৈরি করে খাওয়াতেন। অতীত দিনের সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পন্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের সুযোগ্য পুত্র পন্ডিত মল্লার ঘোষও তাঁর অল্পবয়সের স্মৃতিচারণা করলেন। 'সপ্তসুর' নামে একটি সঙ্গীতায়ন গড়ে তুলেছিলেন দীপালি নাগ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঙিনায় তিনি অভিনব কোরাস অর্থাৎ বৃন্দগান রচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পর সেই উদ্যোগ থেমে গেছে। কাকলি সেনের অনুপ্রেরণায় 'পাঁচটি গানের গল্প' নামে দীপালি নাগের ওপরে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম দীপালি নাগকে প্রথম দেখেন ১৯৩৮ সালে। তিনি যখন শুনলেন দীপালি নাগ থাকেন আগ্রায়, তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন - তুমি বাংলা জানো? তারপর অনেক ইতিহাস তৈরি করেন দীপালি নাগ। তিনি নজরুলের মোট আঠারোটি গান রেকর্ড করেছিলেন। দীপালি নাগের স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী বি ডি নাগচৌধুরী (বাসন্তী দুলাল নাগচৌধুরী)। বাস করতেন বেহালায় তাঁদের সুসজ্জিত গৃহে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তারকাদের নিত্য যাওয়া আসা ছিল সেই আবাসে। দীপালি নাগ জীবনের শেষ বেলায় কলকাতা ছেড়ে আহমেদাবাদে পুত্রের আশ্রয়ে গিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যাবার দিনটি ছিল বৃষ্টিস্নাত কলকাতার একটি ধূসর দিন। গান্ধীনগরে শীঘ্রই তাঁর শেষ দিন ঘনিয়ে আসে। কিন্তু জীবন এমন নিষ্ঠুর যে সেদিনও দীপালি নাগকে শেষযাত্রায় যেতে হয়েছিল পুষ্পহীন শকটে।
বিদূষী দীপালি নাগের জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে সঙ্গীত জগতে বিশেষ হেলদোল দেখা যাচ্ছেনা, এটা বিস্ময়কর। তবে ছায়ানটের সভায় উপস্থিত ছিলেন চন্ডীগড়ের এক অনুরাগী সঙ্গীত
গবেষক ড.সঙ্গীতা লাহা চৌধুরী। কাজী নজরুল ইসলামের উপর গবেষণা করার সময় তিনি দীপালি নাগের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সময়ে যে স্নেহ আর আতিথেয়তা
তাঁর ওপরে বর্ষিত হয়েছিল সেটাকে তিনি জীবনের এক পরম সঞ্চয় মনে করেন।
সভায় ছায়ানট কলকাতার পুরোধা সোমঋতা মল্লিক দীপালি নাগের জীবনের নানা অধ্যায় তুলে ধরলেন কাকলী সেনের গ্রন্থের নির্বাচিত অংশ পাঠের মাধ্যমে। বক্তা অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্মৃতিচারণা করেন। সভায় সভাপতি ড. মনতোষ দাশগুপ্ত তাঁর সঙ্গে বাসন্তী দুলাল নাগ চৌধুরীর বন্ধুর সূত্রে শ্রীমতী দীপালি নাগের সংস্পর্শে এসেছিলেন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে। তিনিও অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেন।
এই সভাকক্ষে শ্রীমতী কাকলী সেন দীপালি নাগের পরিণত বয়সের একটি দুর্লভ জীবন্ত ছবি হাজির করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। সেটির কথা আলাদা করে না বললেই চলে না। সভার শেষদিকে সুরের মূর্ছনা আনলেন সোমঋতা মল্লিকের পরিচালনায় তাঁর গোষ্ঠী ছায়ানটের গাওয়া দুটি সুখশ্রাব্য নজরুল গীতি পরিবেশন করে। পরিশেষে, মধুরেণ সমাপয়েৎ! দীপালি নাগের কণ্ঠে গান শোনা গেল পুরনো রেকর্ড থেকে। এই প্রতিবেদকের একবার সুযোগ হয়েছিল নাগদম্পতির ড্রয়িং রুমে ঘন্টা খানেক অবস্থান করার। প্রখ্যাত বিজ্ঞানীকে একটি বিজ্ঞান সভায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। সেই দিন মনে হয়েছে ওটা ড্রয়িং রুম নয়, একটি সাজানো গোছানো মিউজিয়াম। সেই গৃহটি এখন অবহেলার শিকার হয়ে পড়েছে। বক্তাদের সকলের কন্ঠে উদ্বেগের ছাপ। এই বিল্ডিংটাকে কি হেরিটেজ বিল্ডি হিসেবে ঘোষণা করা যায় না ?