আমাদের সবার আগে ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে: সাই পল্লবী
তাবৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিস্ময় বলা হয় দক্ষিণী নায়িকা সাই পল্লবীকে। যৌন উত্তেজনা, উগ্র পোষাক, শরীরের প্রদর্শনী, এমনকি, মেকআপ পরিহার করে শুধুমাত্র অভিনয়শৈলীতে একনম্বরে চলে আসার সাফল্য পল্লবী ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার খুব কম নায়িকারই আছে। শনিবার (১৮ জুন) প্রথমবারের মতো ফেসবুক লাইভে এসে তিনি পুনরুল্লেখ করেন, 'আমাদের সবার আগে এক ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে। আমরা যদি ভালো হই, তাহলে অন্যকে আঘাত করব না।’
কিছুদিন আগে এক সাক্ষাতকারে মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সহিংসার বিরুদ্ধে কথা বলা সাই পল্লবী ইংরেজিতে দেওয়া পাঁচ মিনিটের ফেসবুক লাইভে নিজের নিরপেক্ষ ও মানবিক অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেন। ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় উগ্রতার পটভূমিতে অনেকেই যখন মুখ খুলতে সাহসী হননি, তখন মানুষ ও মানবতার পক্ষে সাই পল্লবীর দ্বিধাহীন বক্তব্য দৃষ্টান্তমূলক। মানবতাবাদী-বিবেকবান মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করলেও তার কথা ধর্মীয় উগ্রশক্তিকে নাখোশ করে। ফলে তিনি ফেসবুকে এসে নিজের মানবিক মতের পক্ষে আরও জোরালোভাবে অবস্থান নেন এবং মানবতাবিরোধী অপশক্তির সমালোচনার জবাব দেন।
সাই পল্লবী বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিকে ঘিরে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘কাশ্মীর ফাইলস ছবিতে দেখানো হয়েছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কীভাবে মারা হয়েছে। আপনি যদি এ ঘটনাকে ধার্মিক সংঘর্ষ হিসেবে নেন, তাহলে কিছুদিন আগেই এক মুসলিম চালককে গরু নিয়ে যাওয়ার অপরাধে মারধর করা হয়। আর তাকে দিয়ে জোর করে “জয় শ্রীরাম” বলানো হয়। এ দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?' তিনি বলেন, 'পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক হিসাবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান। মত ও পথের ভিন্নতার কারণে কাউকেই নিধন করা যায় না।'
সাই পল্লবী তার রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি এক নিরপেক্ষ পরিবারের মধ্যে বড় হয়েছি। আমাকে এখানে সব সময় এক ভালো মানুষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে আমি সেসব মানুষকে যেন রক্ষা করি, যারা অসহায় আর কোনও বিপদের মধ্যে আছে। উৎপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা আমায় দেওয়া হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে সে কত বড় বা ছোট মাপের মানুষ, বা কোন মতের মানুষ, তা যেন না দেখি।'
'বামপন্থী আর ডানপন্থীর বিষয়ে শুনেছি আমি। আমি নিশ্চিত যে আমি কোনও পন্থী নই। আমি নিরপেক্ষ এবং মানুষের পক্ষে', স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন সাই পল্লবী।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ধর্মীয় উগ্রতাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের পটভূমিতে সাই পল্লবীর বক্তব্য ভারতের চিরায়ত গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের প্রতি সমর্থনের ধ্বনিই উচ্চারণ করেছে, যে শাশ্বত মতাদর্শ উগ্রশক্তির কবলে প্রায়ই বিপন্ন হয়ে চলেছে।
একজন চিকিৎসক, উচ্চশিক্ষিত, ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যে পারদর্শী সাই পল্লবী, একনম্বর তেলেগু অভিনেত্রী হয়েও পুরো দক্ষিণ ভারত এবং সমগ্র ভারতীয় চলচ্চিত্রের সম্মানজনক ও জনপ্রিয় অগ্রণী নায়িকা। যিনি প্রেমাম, কালি, ফিদা, আথিরান এবং এমসিএ-মিডল ক্লাস আববায়ির মতো ব্লকবাস্টারে অভিনয় করেছেন।
ইউটিউব চ্যানেল 'গ্রেট অন্ধ্র'র সাথে অতি সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারের সময়, অভিনেত্রী তার মন্তব্যে বেশ সৎ ছিলেন এবং তিনি ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তার মন্তব্য ছিল স্পষ্ট। তিনি হিন্দুদের কাশ্মীর গণহত্যা মতোই ধর্মের নামে একজন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি উভয় ধর্মীয় অসহিষ্ণু মনোভাবের নিন্দা করছিলেন এবং বলেছিলেন, 'যেখানে লোকেরা কোনও আপাত কারণ ছাড়াই ঘৃণার অনুভূতি রাখে এবং ধর্মীয় লাইনে একে অপরকে আঘাত করে, যা তার দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য।'
তেলুগুতে তার আসন্ন ছবি "বিরাতা পার্ভম" এর প্রচারের সময় এই মন্তব্যগুলো করেন পল্লবী। তিনি স্পষ্টই বলেন যে, একটি নিরপেক্ষ পরিবারে বড় হয়ে ও উদার শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে তিনি একজন ভাল মানুষ হওয়ার শিক্ষাই লাভ করেছেন। শৈশবে, তাকে ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে সামাজিকভাবে নিপীড়িত লোকদের রক্ষা করতে শেখানো হয়েছিল। তিনি এই বার্তাটি ভারতের জনগণ এবং তার ভক্তদের কাছে পৌঁছে দিয়ে চান।
সাই পল্লবীর মন্তব্যর পর নেট দুনিয়ায় উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুরা বিরূপ হয়ে রীতিমতো ঝড় তুলে। তবে, তার পক্ষেও প্রশংসনীয় মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা। এমন পটভূমিতে প্রথমবারের মতো লাইভে এসে সাই পল্লবী দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক মতাদর্শিক অবস্থান সাহসিকতার সঙ্গে পুনরুল্লেখ করেন।
নিজের স্বচ্ছ অবস্থানের মতোই সাই পল্লবী স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বেছে বেছে খুবই কম ছবিতে অভিনয় করেন। কাহিনীর গভীরতা ও বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে অভিনয়ের শতভাগ সততা প্রদর্শনের কারণে তিনি অনেক পরিচালক-প্রযোজকের কোটি কোটি টাকার ছবি অবলীলায় ফিরিয়ে দেন। বলিউড তথা ভারতীয় ছবির অবক্ষয় ও বিকৃতির বিরুদ্ধে হিম্মতের সাথে দাঁড়ানো অন্যতম শিল্পী সাই পল্লবী তিরিশ বছর ছোঁয়ার আগেই স্পর্শ করেছেন নিজের সম্মানীত অবস্থান। তার অভিনয় কৃতিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গির শুদ্ধতা ও নান্দনিক পরিচ্ছন্নতার কারণে তাকে স্থান দেওয়া হয় অনন্য অভিনেত্রী শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, কিরণ খেরের পাশে।
সাই পল্লবী এখন ব্যস্ত তার আগামী রোমান্টিক অ্যাকশন-পলিটিক্যাল-ড্রামাভিত্তিক দক্ষিণ ভারতীয় ছবি ‘বিরাট পর্ভম’-এর মুক্তিকে ঘিরে। এ ছবিতে নায়ক রানা দাজ্ঞুবতির সঙ্গে তাকে চ্যালেঞ্জিং অভিনয় করতে দেখা যাবে। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এক তরুণীর প্রেমকথা নিয়ে এ ছবির গল্প বোনা হয়েছে। তরুণীটি যে কারণে বিপজ্জনক নকশাল নেতা রাবণকে ভালোবেসে ফেলে। পল্লবী তার অতীতের ছবিগুলোর মতো এতেও অভিনয়ের সংবেদনশীল স্পর্শকাতরতায় সাফল্যের শিখরস্পর্শী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবেন বলে ছবি মুক্তির আগেই প্রিভিউ দেখে বোদ্ধা-সমালোচকরা বলতে শুরু করেছেন। তার এই ছবির ট্রেলার মুক্তি পেতেই কয়েক মিলিয়ন ভিউ পেয়ে গেছে। ভারতের সিভিল সমাজ ও মূলধারার মিডিয়া মনে করছে, পল্লবীর নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক অবস্থান নিয়ে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু-উগ্রপন্থীদের বিতর্ক তৈরির অপচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করেছে সাধারণ মানুষ।