বাবার বিয়ে



সানজিদা আমীর ইনিসী
অলঙ্করণ: শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ: শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার মা মারা যাওয়ার পরের দিনে আমার দাদি বাবার জন্য মেয়ে দেখতে গেছিলেন। আমি থ্রিতে পড়ি তখন। মেয়ে দেখা, বিয়ে হওয়া এইসব বুঝি। মেয়ে দেখার কথা আমি আমার খালারে বললাম। খালা শুইনা কান্নাকাটি শুরু করল। আমারে বলল, “কপাল মন্দ। কী করবা মা!”

আমি কী করব জানতাম না। আসলে বাবা বিয়ে করলে কী-কী হবে তাও ঠিকঠাক বুঝতাম না। আত্মীয়স্বজন কারো সৎ মা নাই। তবে সৎ মা’রা কেমন হয় তা অনেক সিনেমায় দেখছি। সেইসবও সত্য বইলা বিশ্বাস করতে পারতাম না।

আমার মা যখন আমারে বকা দিত, তখন মা’রে বলতাম, “তোমারে বিক্রি কইরা বাজার দিয়া আরেকটা মা কিনা আনব।”

মা বলত, “তাইলেই সারছে! সেই ঘরে তোর আর ভাত খাওয়া লাগবে না।”

মা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলত। আর সত্যি সত্যি, মা’র বলার ধরনে আমার ভয় লাগত। তখন ভাবতাম, মা সম্ভবত একজনই। ভাবতে ভাবতে বইতে পড়া পোয়েমের লাইনগুলি মাথায় ঘুরত।

“I know a face, a lovely face,
As full of beauty as of grace,
A face of pleasure, ever bright,
In utter darkness it gives us light
A face that is itself like joy,
To have seen it I’m a lucky boy
But I’ve a joy that have few others
This lovely woman is my mother.”

আমি বারবার বিড়বিড় করতাম “This lovely woman is my mother.”

আমি বাবাকে বললাম, দাদি মেয়ে দেখতে গেছিল। আর এও বললাম, আবার মেয়ে দেখতে গেলে আমি বাসা থিকা চইলা যাব। আর কখনো বাসায় ফিরব না। কথা বলতে বলতে আমি কাঁদতে ছিলাম। গলা বন্ধ হইয়া আসতেছিল। হাত-পা ঠান্ডা হইয়া যাইতেছিল। বইসা যেন ঠিকমতো বুঝায়ে বলতে পারতেছিলাম না। তাই দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে কথা বললাম। বাবা দাদিকে আমার সামনে মেয়ে দেখতে মানা করল। মানা করায় দাদি নিষ্ঠুরভাবে হাসলেন। তার হাসি দেইখা আমি আমার সামনে থাকা ফ্লোয়ার ভ্যাস ছুইড়া মারলাম মেঝেতে। সেইটা ভাইঙা কয়েক টুকরা হইল। বাবা কিছু বলল না। ঘর থিকা বের হইয়া গেল।

আমি দরজা আটকাইয়া অনেকক্ষণ কানলাম। মা’র ছবি বাইর কইরা দেখতে শুরু করলাম। সব ছবিতে মা হাসতেছে। আমার চোখের পানি অ্যালবামের ওপর টপাটপ পড়তে লাগল। মা’র মুখের ভঙ্গি তারপরেও একই রকম থাকতেছে। অথচ গতদিন, এই গতদিনও আমি কানলে মা’র চোখ ছলছল করত।

খালা বাসায় আইসা ডাকাডাকি করল। দরজা খুললাম। জড়ায়ে ধরলাম। কানলাম।

“খালার গা থিকা মা’র মতো গন্ধ আসে”—এইটা জানা থাকার জন্য কি-না জানি না, তবে মা’র গা’র গন্ধই পাইতেছিলাম। আমার ঘুম আসলো গন্ধে। আমি খালার কাঁধের ওপরই ঘুমায়ে পড়লাম।

দাদি এরপর সত্যিই মেয়ে দেখা বন্ধ রাখছিলেন। আমার সাথে আমার ফুফাত বোন থাকত। আমার চেয়ে সাত-আট বছরের বড়। মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করছে, আর পড়াশোনা করবে না, তাই সে আইসা থাকত। আমারে স্কুলে নিয়া যাইত, নিয়া আসত। ভাত খাওয়ায় দিত, গোসল করায় দিত, ঘুম পাড়ায় দিত। দাদি অন্য রুমে থাকতেন। সারাদিন তজবি জপতেন, আমারে দেখলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনলে আমার গা জ্বইলা যাইত। তখন চোখমুখ এক কইরা চুপচাপ বইসা থাকতাম।

মা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে কোচিংয়ে যাওয়া শুরু করছিলাম। কোচিংয়ে নতুন এক ম্যাডাম আসছেন। একটু পর দেখলাম, সবাই তারে ঝর্ণা ম্যাডাম বইলা ডাকতেছে। আমার মা’র নামও ঝর্ণা। ম্যাডামের মুখের দিকে তাকাইতে আমার মন খারাপ হইল। ম্যাডাম সব জানতেন, এবং পুরো ক্লাস আমার পাশে বইসা রইলেন। মাঝেমধ্যে মাথায় হাত বুলাইতে ছিলেন। আমি চেষ্টা করতেছিলাম না কাঁদার জন্য। কিন্তু ম্যাডাম যখন বললেন, “থাক মা, মন খারাপ করে না”, তখন মুখ স্বাভাবিকের চেয়ে আরো নিচু কইরা ফেললাম। ক্লাসের সবাই তখন লেখা রাইখা আমার দিকে তাকায়ে আছে, কেউ কেউ কাঁদতেছে।

বাবা বিয়ে করল মা মারা যাওয়ার নয় মাস পর। এই নয় মাস প্রায় প্রতিদিন দাদির সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে ঝামেলা হইত। বাবার চাকরি পটুয়াখালী, পটুয়াখালী থাকতে হয় তার। বৃহস্পতিবার রাত্তিরে বাসায় আসে, শুক্র শনিবার থাকে, রবিবার সকালে আবার চইলা যায়। দিনে আমি বাসায় থাকায় দাদি আমার ব্যাপারে বাবারে নালিশ করতে পারত না। তাই সে রাতে নালিশ করত। রাত তিনটা চারটার দিকে। আমি বাবা আসলে বাবার সাথে ঘুমাই। দাদি আর আপু অন্য রুমে। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভাইঙা গেল। লাইট জ্বলতেছে দেখলাম। দেখে চোখ বুজলাম। বুঝলাম দাদি বইসা আছে খাটের সামনে, সোফায়। বাবা তার পাশে। আমি রাগ দেখাই, ভাঙচুর করি, শুধু খালার কথা শুনি, তাদের কথা শুনি না—এসব বলতেছিলেন। বাবা শুইনা গেল। কিছু বলল না।

দাদির সাথে সমস্যা শুরু হইছিল মা’র তিনদিনের মিলাদের দিন। মিলাদের আগে দাদি মা’র ব্যাপারে ঠেস দিয়া কথা বলতেছিলেন। ঘর ভর্তি মানুষ ছিল সামনে। আমি শুনলাম শুধু। বাবাকে এই কথা পরে বলছি, সেও কিছু বলে নাই। বাবার কিছু না বলাতে আমার ভীষণ রাগ হইছে, এবং তার পর থিকা আমি দাদিকে একদম পছন্দ করি না।

আমি ফোরে ওঠার পর আপু আমাদের বাসা থিকা চইলা গেল। তার বিয়ে ঠিক হইছিল।

আপু ছাড়া বাসার কাজকর্ম করার কেউ নাই যেহেতু, বাসা ছাড়া হইল। মালপত্র পটুয়াখালী নিয়া গেল। আমি খালার কাছে রইলাম। বরিশালে। খালার ছেলেমেয়েদের বিয়ে হইয়া গেছে, সে একলা থাকে বিধায় ঝামেলা নাই।

খালা মাঝেমধ্যে আমারে বুঝাইত। বাবার বিয়ের ব্যাপারে। সে নিজেও মেয়ে দেখত। পছন্দ হইলে বাবারে জানাইত।

কিছুদিন পর একটা মেয়ে বাবার পছন্দ হইল। আমারে তখন সকাল-বিকাল নিয়ম কইরা বোঝানো হয়। দূরের আত্মীয়স্বজনরা ফোন কইরা বুঝান। আমি মাথা ঝাঁকাই, হু হু বলি। কান্নাকাটি করি। ছাদে গিয়া একলা বইসা থাকি। খালা আমারে ভূতের ভয় দেখাইত। ছাদে একলা থাকলে ভূত নাকি নিয়া যায়। আমি এইসব ভয়ের ধার ধারতাম না। আমি হুট কইরা ছোট থিকা বড় হয়ে গেছি। অনেক বড়, কখনো কখনো আমার আশপাশের সবার চেয়ে বড়।

কোচিং থিকা বাসায় ফেরার পথে আমি অনেক রাস্তা ঘুইরা হাঁইটা আসতাম। ব্যাগে রিকশাভাড়া জমা থাকত। জ্বর হইলে একলা ডাক্তার দেখাইতাম। ডাক্তার যখন দেখেন থ্রি কোয়ার্টার, ফতুয়া পরা, কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়া একটা মেয়ে একা আসছে তখন তার চোখেমুখে অবাক হওয়া ভাব থাকে। আমার তা ভালো লাগে। আমার মতো কেউ নাই আমার ক্লাসে। সবাই একলা রাস্তায় হাঁটতে ভয় পায়। রাস্তা পার হইতে ভয় পায়। আর একলা ডাক্তার দেখানো, হিহি, তা তো ভাবতেই পারে না। আমি ডায়েরি লিখতাম প্রতিদিন। কী-কী হইতেছে সব লিখে রাখতাম।

বাবার বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা হওয়ার পর একদিন আমাকে মেয়ের বাসায় নিয়া যাওয়া হইল। সাথে আমার খালা আর কাকা ছিলেন। আমি এই হবু মা’কে কী ডাকব বুঝতেছিলাম না। তার ওপর রাগ হইতেছে খানিক। কিন্তু সে দেখলাম খুব সহজ ব্যবহার করল। আমি হাত দিয়া খাইতে পারি না জানত। আমাকে খাওয়ায় দিলো। কথা বলল।

জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার পড়াশোনা শেষ?”

“অনার্স শেষ। আরো অনেক আগে।”

“কী সাব্জেক্ট?”

“ফিজিক্স।”

“মানে অংক?”

“না। অংক না। তবে অংক আছে।”

কথা বইলা আমার ভাল্লাগল। বাসায় ফেরার পর আমার মতামত জানতে চাওয়া হইল। আমি সংক্ষেপে ‘হ্যাঁ’ বইলা প্রত্যেককে বিদায় দিলাম।

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।

আমার বয়স দশ।

খালার বাসায় লম্বা বারান্দা আছে। কোনায় একটা ইজিচেয়ার থাকে। আমি বইসা রইলাম সারা সকাল। মা কিভাবে চইলা গেল ভাবতেছি। গায়ে একটা হলুদ রঙের তাঁতের জামা ছিল। কুয়াকাটা থেকে কেনা। কতবার আমরা কুয়াকাটা গেছি, মা’র পাশে হাত ধইরা বালিতে হাঁইটা বেড়াইছি বা হাঁটছি ঝাউ গাছের পাশে। কতবার কত কম দুঃখে সারা দুপুর জড়ায়ে, পারলে কলিজার ভেতর ঢুইকা ঘুমাইছি। অথচ আজকের দিনটা কত দুঃখের, কত বিষণ্ণ।

২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহ হইছে। নিউজ চ্যানেলে বলতেছে কী-কী যেন। বাবা টিভি দেখতেছে। পাশে ছোট কাকা। আমি ঘুইরা আসলাম তাদের সামনে থেকে। কারো সাথে কোনো কথা হয় নাই।

ছোট কাকা ঢাকা থিকা আসছে, বাবার বিয়ে উপলক্ষে। আজকে বাবার বিয়ে। সবাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি স্বাভাবিক। হবু মামা ইয়োলো একটা জামা পাঠাইছেন আমার জন্য। এইটা পইরা যাব, যেহেতু একদম নতুন।

খালার রুমে পালঙ্ক আছে। তার শ্বশুরের আমলের। পালঙ্কের মাথার কাছে বিশাল একটা মূর্তি। চোখ বন্ধ কইরা আছে। যেন সে পৃথিবীর ঘটমান কিছুই দেখতে চায় না; আমার মতো। আমি অনেকক্ষণ বইসা মূর্তিটা দেখি। দেখতে দেখতে আমার কাঁদতে ইচ্ছা করে। পাশের রাস্তায় জোরে গাড়ির হর্ণ পড়লে কাঁদার ইচ্ছা কমে।

দুপুরে বিয়ে হবে। আমরা একটার দিকে যাব। খুব অল্প মানুষ। আমার দাদাবাড়ির দিকের ছোট কাকা ছাড়া কেউ নাই। আর আমার আপন খালা, মামা, খালাত বোনেরা আছে।

কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হয় নাই। মানুষজন কম যেহেতু, বাসাতেই বিয়ে হইছে। বাসায় আমার হবু মা’র মা, ভাই, ভাইয়ের বউ, বোন, বোনের জামাই আর তাদের বাচ্চাকাচ্চারা আছে। বিয়ে পড়ানোর পর দাদির সাথে বাবার ফোনে কথা হইছে। দাদি হয়তো এই বিয়েতে খুশি হন নাই। কারণ তার পছন্দে বিয়ে হয় নাই।

সিগনেচার-টিগনেচার হইয়া যাবার পর খালাত বোন আইসা তার চোখমুখ উজ্জ্বল কইরা আমাকে বলল, বিয়ে হয়ে গেছে।

সে সম্ভবত দেখতে চাইতেছিল আমি কী বলি বা কী করি।

আমি তারে বললাম, “এই বাসার বড় মামি মাটন চাপটা অনেক ভালো বানায়। আজকে খাইয়া দেইখো। আমি আগেও খাইছি।”

আপুর উৎসাহে ভাটা পড়ায় চেহারা বিমর্ষ হইল। সে চেয়ার টাইনা আমার থিকা দূরে গিয়া বসল।

আমার তখন আমার চারপাশের সবার মতো সবটা স্বাভাবিক মনে হইতেছে।

আমরা পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিছি বিকাল চারটায়। মাইক্রোর সামনে ড্রাইভারের পাশে বাবা বসছে। পেছনে আমি আর মা।

একটু পর মা’কে বললাম, আপনাকে সুন্দর লাগতেছে।

“থ্যাংক ইউ! মা’কে কেউ আপনি কইরা বলে নাকি! ‘তুমি’ বলবা।”

“আচ্ছা।”

মা’র খুব বেশি জার্নির অভ্যাস নাই। ভাঙা রাস্তার ঝাঁকাঝাঁকিতে বমি করল কয়েকবার। বমি করার আগে আমাকে বইলা নিলো, “তুমি সইরা বসো। আমার দিকে তাকায়ো না। বমি করতে দেখলে তোমারও বমি আসবে।”

আমি অন্যদিকে তাকায় থাকলাম। থাকতে থাকতে ঘুমায় গেলাম। পটুয়াখালী গিয়া যখন মা ডাক দিলো, তখন বুঝলাম ঘুমাইয়া গেছিলাম মা’র কাঁধের ওপর।

তারপর ঘুমজেগে অনেকদিন আর অনেকরাত পার করছি। এইসব দিনরাত্রিতে মা এক রাতে বলছিল, আমি বড় হইলে পরে অনেক গল্প হবে। এইটুক কথা বলতে মা কাঁদছিল সেই রাতে।

আমাদের সম্পর্ক যাই হোক না কেন, একটা কথা, একটা ডাক, আমাদের পিছু ডাকে সবসময়। আমি আমার আপন মা’র থিকা বেশি সময় ধরে তারে মা ডাকতেছি। মা’রেও আমার আগে কেউ মা ডাকে নাই। এই ব্যাপারগুলি আমাদের বাঁইধা রাখে। মাঝে ভালো দিন, কথা বন্ধের দিন, মুখে ভাত তুইলা খাওয়ায়ে দেওয়া দিন, হাসিঠাট্টার দিন, বিষণ্ণ দিন—কতদিন নদীর মতো বয়ে গেছে। আমি টের পাই না। দেখতে পাই ফ্রেমে থাকা আমাদের দিনগুলি; ভালো দিনগুলি নিয়ে যেসব বাঁধায়ে রাখছিলাম।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;