শতাব্দীতে একটি সুযোগ পায় মিয়ানমার, কিন্তু কাজে লাগে না

  • খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিগত তিন শতাব্দীতে একটি করে সুযোগ এসেছে মিয়ানমারের জন্য। কিন্তু তা টেকেনি।

মিয়ানমারের ১৯, ২০ এবং ২১ শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৮৮৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ বিগত ১৩০ বছর ধরে মিয়ানমার দু’টি অযাচিত রাজনৈতিক প্রবঞ্চণা সহ্য করেছে, এর একটি সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যটি কর্তৃত্ববাদ (সামরিক কর্তৃত্ববাদ)।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমারে ২০২০ সালের শেষের দিকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতিগত সংখ্যালঘু অঞ্চল বিশেষত রাখাইন রাজ্যে, নির্বাচন, গণতন্ত্র সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সহিংসতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

১৮৮৫ সালের ২৮ নভেম্বর মিয়ানমারের মান্ডালে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ চূড়ান্ত দখল এবং রাজা থিবাওয়াকে পদচ্যুত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে সমস্ত মিয়ানমারে উপনিবেশ স্থাপন করল। ১৯ শতকে দেশটির কেউ কল্পনাও করতে পারত না যে তারা ব্রিটিশদের অধীনে বাস করবে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল নে উইন যখন দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখনও মিয়ানমারের কেউ স্বপ্নেও দেখেনি যে তাদের দেশ প্রায় পরবর্তী ৬০ বছর সেনাবাহিনী দ্বারা শাসিত হবে।

ব্রিটিশরা ১৮৮৬ সাল থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত ৬২ বছর সময়কালে মিয়ানমার শাসন করেছিল। স্বাধীনতার পর ১০ বছর গণতন্ত্র ছিল মিয়ানমারে। স্বাধীনতার পরে প্রধানমন্ত্রী ইউ নয়ের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক দশক টিকেছিল।

১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হল সামরিক শাসন। সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল নে উইন যে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন তা ৫৮ বছর টিকেছিল।
এ উভয় রাজনৈতিক শক্তির একই রকম প্রভাব ছিল, তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে মিয়ানমারের জনগণের ক্ষমতা দাবিয়ে রেখেছিল।

১৮৫২ সালে ব্রিটিশরা দেশটি উপনিবেশের জন্য দ্বিতীয় অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের সময় মিয়ানমারের ইতিহাসের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় রাজা মিনডন দেশটি পুনর্নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার রাজত্বকাল (১৮৫৩-১৮৭৮) আধুনিকীকরণের সময়কালে তার প্রগতিশীল রাজ সদস্য এবং মন্ত্রীদের সহায়তায় রাজা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী উত্থানের কারণে তার দেশ পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।
রাজা মিনডন মিয়ানমারের কংবাং রাজবংশের সংস্কারবাদী শাসক ছিলেন। তিনি যে সংস্কার চেয়েছিলেন, তারই প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর। এতে মিয়ানমার পুনর্নির্মাণের দ্বিতীয় সুযোগটি এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী ইউ নয়ের এক দশকের শাসনামল মিয়ানমারের জন্য স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত। এ সময় এখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার দ্বারা চিহ্নিত এবং এশিয়ার অন্যতম প্রাণবন্ত অর্থনীতি ছিল। তবে এ দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটিও গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে জেনারেলদের দ্বারা সামরিক শাসন চাপানো ব্যাহত করা হয়।

২০১১ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবং তাদের উত্তরাধিকারী, ইউ থেইন সেনের নেতৃত্বে মনোনীত একটি বেসামরিক সরকার, ন্যাশনাল লীগের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

যদিও তার সরকার কিছুটা হলেও দেশটিকে উন্মুক্ত করেছিল। তবে এটি কোনও উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক সংস্কার ছিল না এবং এনএলডি ও প্রধান নৃগোষ্ঠীসহ বেশিরভাগ গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো বয়কট করেছিল এমন একটি ‘কারসাজির’ নির্বাচনের ফলাফল হিসেবে তার সরকার গঠিত হয়েছিল।

দেশটি পুনর্নির্মাণের তৃতীয় সুযোগ আসে ২০১৫ সালে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। এ নির্বাচনে ভোটে বিজয়ীরা ৫৮ বছরে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সরকার গঠন করতে পেরে দেশটি পুনর্নির্মাণের তৃতীয় সুযোগটি সত্যিই শুরু করে দিয়েছিল।
মিয়ানমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক হচ্ছেন সু চি এবং ২০১৫ সালে দেশটির জাতীয় নির্বাচনে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ভূমিধস জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রিসভা এবং তার দলের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন সু চি।

১৯, ২০ এবং ২১ শতক। প্রতি শতাব্দীতে একটি করে সুযোগ এসেছে মিয়ানমারের জন্য। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ১০ বছরে দেশটি চলমান গৃহযুদ্ধ মোকাবিলা করছে। যদিও এখন আরও বেশি সশস্ত্র দল সক্রিয় রয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে।

পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কট, দেশটিকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে দেশটি আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে এবং বেসামরিক সরকার ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে এ নিয়ে বিভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এসব সমস্যা এ তৃতীয় সুযোগটিকেও ডুবিয়ে দেবে কিনা কেউ জানে না।
যদি মিয়ানমার আবার ব্যর্থ হয়, তাহলে এ শতাব্দীতে নিজেকে পুনর্নির্মাণের আরেকটি সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মিয়ানমারের কেউই এ বিরল সুযোগটি হারাতে চায় না। কেউ চায় না, আবার ৬০ বছরের জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও কর্তৃত্ববাদের অধীনে থেকে এ শতাব্দী শেষ করতে।

আপাতত, কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভঙ্গুরতার কারণে এ তৃতীয় সুযোগটি ব্যাহত হবে কিনা, যেমন ১৯ এবং ২০ শতকে হয়েছিল।

দেশের নেতাদের পাশাপাশি মিয়ানমার এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষকসহ প্রায় সবাই মিয়ানমারের ইতিহাসে এ সময়কে গণতান্ত্রিক উত্তরণ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা ভুল না। মিয়ানমারের পক্ষে গণতান্ত্রিক রূপান্তর অন্য দেশে যতটা না হয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের তার পুরনো রাজনৈতিক রীতিটি ভেঙে ফেলার সুযোগ রয়েছে। কারণ গণতন্ত্র এলেও এখনও দেশটির কর্তা সেনাবাহিনী। দেশটির পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন এখন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনী আরো বেশি ক্ষমতা দাবি করছে।