মানবদেহ কী উপাদান দিয়ে তৈরি
নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবুন তো কী কী উপাদান নিয়ে আপনার শরীর গঠিত হয়েছে? আপনার শরীর যে সুস্থ আছে, তাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করছে কোন কোন উপাদান? আপনি যদি শরীরগঠনের উপাদানের একটা তালিকা তৈরি করেন তাহলে অবাক হয়ে দেখবেন আপনার শরীরগঠনে জড়িয়ে আছে সালফার, ম্যাগনেসিয়াম,পটাসিয়ামের মতো বিভিন্ন উপাদান। আপনি কি জানেন সালফার আপনার শরীরে কী করে? ম্যাগনেসিয়াম কেমন? পটাসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা কী? এসব ব্যাপার নিয়েই আজকে আমরা আলোচনা করব।
মানবদেহ প্রায় ৬০টি রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গঠিত, তবে আপনার দেহের বিশাল অংশ (প্রায় ৯৯ শতাংশ!) মাত্র চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত—অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেন এবং এসব উপাদানের একটা বড় অংশ আমাদের শরীরে জল আকারে আসে। বাকি ৪ শতাংশ উপাদান খুব মুখ্য ভূমিকা পালন না করলেও এগুলো এই চার উপদানকে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে।
মানবদেহে অক্সিজেন রয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। অনেক বেশি হওয়ায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অক্সিজেন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। তবে তার অর্থ এই নয় যে আমাদের শরীর কেবল বাতাস দ্বারা পূর্ণ। আমাদের দেহে যে অক্সিজেন আছে তার বেশিরভাগ অক্সিজেন পানি আকারে হাইড্রোজেনের সাথে আবদ্ধ। আপনি হয়তো এটি আগেও শুনেছেন, তবে এটি সত্য যে মানবদেহের প্রায় ৬০ শতাংশ জল এবং এর বেশিরভাগ অংশ মূলতঃ অক্সিজেন। সেই জল আপনার শরীরে কেবল ওজন বৃদ্ধি করে এমন না, এগুলো শরীরের তাপমাত্রা এবং অসমোটিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
অক্সিজেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ফুসফুস এবং রক্তে পাওয়া যায়। কারণ অক্সিজেন হলো বায়ুবাহি কোষীয় শ্বসনের (Aerobic cellular respiration) একটি কেন্দ্রীয় উপাদান, যেখানে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া অক্সিজেন ব্যবহার করে গ্লুকোজকে (চিনি) ভেঙে ফেলে এবং এটিপি (ATP) নামে পরিচিত অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট তৈরি করে। এটিপি (ATP) হলো অণু যা খাদ্য থেকে আমাদের দেহের অন্যান্য সেলুলার প্রক্রিয়াগুলোতে শক্তি স্থানান্তর করে।
সুতরাং অক্সিজেন সবসময় আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক এবং প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। কিন্তু অতিরিক্ত কিছুই যেমন ভালো নয়, তেমনি অক্সিজনও। খুব বেশি অক্সিজেন শরীরের কোষ এবং টিস্যুকে ধ্বংস করে এবং শরীরে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে।
এ তো গেল অক্সিজেনের কথা। অক্সিজেনের পরেই আসে কার্বন। মানবদেহের উপাদানগুলোর মধ্যে কার্বনের অবস্থান অক্সিজেনের পরেই। এটি আমাদের শরীরের ১৮ শতাংশ তৈরি করে। কার্বনকে ‘জীবনের সমার্থক’ বলা হয় কারণ এর ৪টি বন্ডিং সাইট দীর্ঘ এবং শক্তিশালী অণুর চেইন তৈরি করে। এগুলি জৈব অণু হিসাবে পরিচিত এবং এতে কার্বোহাইড্রেট, লিপিড (ফ্যাট), প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড (যা ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরি করে) অন্তর্ভুক্ত। আর এই কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন দূরের কোনো গ্রহে জৈব অণু খুঁজে পান তখন তারা খুবই আশাবাদী হন। কেননা এই কার্বন-ভিত্তিক অণুগুলো জীবন তৈরির মূল উপাদান। আর এগুলার অস্তিত্ব পাওয়া মানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা।
অক্সিজেন এবং কার্বনের পরে মানবদেহ গঠনের দৌড়ে যার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেটি হলো হাইড্রোজেন। এটি মহাবিশ্বের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় উপাদান হলেও মানবদেহে এর প্রয়োজনীতা তৃতীয় স্থানে আছে। হাইড্রোজেন আমাদের শরীরের ১০ শতাংশ তৈরি করে। আপনি সম্ভবত জানেন যে জলের প্রতিটি অণুতে (H2O) দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যদি অক্সিজেন মানবদেহের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে, আর তা যদি জল হিসেবে থাকে তাহলে, মানবদেহের বেশিরভাগই মূলত হাইড্রোজেন। শরীরে হাইড্রোজেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ডিএনএ’র মধ্যে। হাইড্রোজেনের বন্ধনগুলিই ডিএনএ-কে তার ডাবল হেলিক্সের আকার দেয়।
আমাদের চারপাশে যে বাতাস আছে তার প্রায় ৭৪ শতাংশ নাইট্রোজেন। মানবদেহে নাইট্রোজেনের স্তর প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে ওঠানামা করে। তবে সেই নাইট্রোজেন চারপাশ থেকে আসে না। বরং মানবদেহে তা আসে খাদ্যগ্রহণ থেকে। এই নাইট্রোজেনের বেশিরভাগকেই জৈব অণুতে অন্যান্য উপাদানগুলোর সাথে আবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। এটি মানবদেহের মাত্র ৩ শতাংশ তৈরি করে। নাইট্রোজেন ভেঙে অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত হয় যা পেপটাইড এবং প্রোটিন তৈরি করে এবং নিউক্লিক অ্যাসিডে পরিণত হয় যা ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরি করে।
শরীরের বাকি অংশগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন এবং ম্যাগনেসিয়াম দিয়ে তৈরি। এর মোট পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। হিসেবে মাত্র ৪ শতাংশ। এই উপাদানগুলো মাংসপেশিগুলিকে কর্মক্ষম রাখে, প্রোটিন তৈরি করে এবং হজমে সহায়তা করে। উপাদানগুলি ছোট হতে পারে তবে শক্তিশালী। এরা মূলত সাহায্যকারী চরিত্রের ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেন, কার্বনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোকে একীভূত করে তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এখানে এমন উপাদান রয়েছে যা মানবদেহের ০.০১ শতাংশেরও কম অংশ গঠন করে যা ট্রেস উপাদান হিসাবে পরিচিত। এই ট্রেস উপাদানের মধ্যে রয়েছে বোরন, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, তামা, ফ্লোরিন, আয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, সেলেনিয়াম, সিলিকন, টিন, ভেনিডিয়াম এবং দস্তা। আরো কিছু উপাদান রয়েছে, কিন্তু সেই অবশিষ্ট উপাদানগুলো আরো কম অংশ তৈরি করে। তবে তাদের সনাক্ত করার অর্থ এই নয় যে তারা গুরুত্বহীন—বরং তাদের কিছু কাজ এখনো রহস্য হিসাবে রয়েছে। বিজ্ঞানীগণ যেই রহস্য উন্মোচনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দিন রাত। তবে এরমধ্যে অনেকগুলোই আপনার বেঁচে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। গ্যালন জল থেকে সোনার ক্ষুদ্রতম কণা পর্যন্ত, আপনার দেহের প্রতিটি উপাদান আপনাকে, আপনার পুরো শরীরকে তৈরি করতে সহায়তা করে। সহায়তা করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে এবং শ্বাস প্রশ্বাস নিতে।