হস্তী বনাম বিড়ালছানা রাষ্ট্রের শিক্ষণীয় গল্প
একটি প্রাপ্তবয়স্ক হস্তী, একটি বিড়ালের তুলনায় ওজনে প্রায় ১২০০ গুন এবং উচ্চতায় প্রায় ১৪ গুন বড় হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ ভারত এবং নেপালের তুলনা অনেকটা রূপক অর্থে হস্তী এবং বিড়ালের মতোই হয়ে যায়। আকার-আয়তনে ভারত নেপালের থেকে প্রায় ২২ গুন বড়! ভারতের সাথে জনসংখ্যা এবং সামরিক শক্তির বিষয়ে নেপালের তুলনা দেওয়াটা হবে অনেকটা হাস্যকর।
নেপাল দীর্ঘকাল ধরেই ছিল ভারত ঘেঁষা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্থানীয় পরাশক্তি হলে কিছুটা দাদাগিরি করবে সেটাই স্বাভাবিক। নেপাল ভারতের সেই দাদাগিরিকে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে আসছিল। নেপালে ভারত প্রীতি এতটাই বেশি ছিল যে তাদের অর্থনীতি ক্রমশ দ্বৈত অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। নেপালে খুব সাধারণভাবেই ভারতীয় মুদ্রা চলত, এমনকি নেপালি জনগণের মাঝে সাধারণ মুদি সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়েও ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ভারতের কাছে নেপাল ছিল একটি আধুনিক ‘কলোনি’, অনেক বিশেষজ্ঞের ভাষায় ‘পাপেট স্টেট বা স্যাটেলাইট স্টেট’।
নেপাল-ভারতের সুখের সংসার চলছিলো বেশ ভালই। হঠাৎ করেই ভারতের গরম ভাতে ছাই পরে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপাল তাদের সংবিধান পাশ করে বসলে। ভারত ভেবেছিল নেপালি সংবিধান থাকবে তাদের প্রভাব বলয়ের আওতায়। এজন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা লম্বা সময় ধরেই নেপালি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল।
নেপালের মদহেশি জাতিগোষ্ঠী এবং মূল ধারার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারতীয় ‘ডাবল স্ট্যান্ডিং থিওরি (দুই পক্ষেই থাকা)’ হঠাৎ করেই ক্ষেপিয়ে তোলে মূল ধারার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে। শেষমেশ ভারতীয় কূটনৈতিক অস্ত্রকে উপেক্ষা করেই নেপাল তাদের সংবিধান পাশ করে ফেলে। সংবিধান পাশের আগে ও পরে ভারতীয় মদদে মদহেশিরা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করলেও শেষমেশ সুবিধা করতে পারেনি।
দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত প্রেমিকা হারানোর ব্যথা অনেক প্রকট। আংশিক সার্বভৌম থেকে সম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রে নেপালের এই রূপান্তরকে ভারত কখনোই ভালো চোখে দেখিনি।
ভৌগোলিকভাবে নেপাল একটি ‘ল্যান্ডলকড কান্ট্রি’, নেপালের তিন দিকে ভারত এবং একদিকে দিকে চীন (তিব্বত)। নেপালের নেই নিজস্ব কোনো সমুদ্র বন্দর। পণ্য আমদানির জন্য নেপালকে তাই নির্ভর করতে হতো ভারতের ওপর। বাধ্যগত নেপাল যখন ভারতের অবাধ্য হয়ে গেল, ভারত তখন এই অস্ত্রটিই ব্যবহার করলো। ভারতীয় অঘোষিত অবরোধে অচল হয়ে পরে নেপাল, খাদ্য-জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতীয় অবরোধে স্থবির হয়ে পরে দেশটি। নেপালের শহরাঞ্চলে চুলা জ্বলতোনা গ্যাসের অভাবে, পেট্রোলের অভাবে এ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে হাসপাতালে না পৌঁছানোর কারণে অনেকের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে নেপালি গণমাধ্যমে। এমন এক পরিস্থিতিতেও ভারতের কাছে মাথা নোয়ায়নি দেশটি, উল্টো ভারতীয় অবরোধের প্রতিবাদে নেপালে সব ধরনের ‘ভারতীয় টিভি চ্যানেল’ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় দেশটি।
দিনে দিনে জল অনেক দূরে গড়িয়েছে , নেপাল এখন অনেকটাই ভারতের হাতছাড়া। ভারত-নেপাল দূরত্বের সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছে চীন। চীনা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে নেপালকে পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়েছে চীন, এর ফলে নেপালের ভারত নির্ভরশীলতা আরও কমবে।
নেপাল ভারত ছেড়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার বাস্তবতা উপলব্ধি করে ভারতীয় সাংবাদিক প্রশান্ত ঝাঁ তাই মতামত ব্যক্ত করেছেন- “......ভারত তার ব্রহ্মাস্ত্রকে হারিয়ে দিয়েছে। আর এখান থেকে লোক খুব সাধারণ এক শিক্ষা নিলঃ কেউ যদি ভারতের বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করে বা চীনের কার্ড খেলে, তাহলে ভারত ভয় পেয়ে সরে আসবে” ।
লেখাটি শেষ করবো নোয়াম চামেস্কির একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে , যে উক্তিটি আমাদের বর্তমান সময়কে চিত্রায়িত করে- “Keep the public busy, busy, busy, with no time to think; back on the farm with the other animals.” নেপালের এই ঘটনা থেকে বিশ্বনেতা এবং সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় আছে। ঢাল তলোয়ারবিহীন একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি কীভাবে পরাশক্তির চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে নেপাল সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। সবসময়ই মনে রাখতে হবে সুবিশাল বৃহস্পতি কখনোই ক্ষুদ্র শুক্রের দিকে আছড়ে পড়ে না, যদি এমনটি হয় তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে।
ফজলে রাব্বী খান: কলামিস্ট এবং প্রকৌশলী